Category Archives: Intercession

Intercession/সুপাৰিছ/ছাফাআত

আসুন সবাই আল কুরআন থেকে সুপারিশ সংক্রান্ত সমস্ত আয়াতগুলো মনোযোগ সহকারে বুঝে পড়ি এবং চিন্তা ভাবনা করে উপলব্ধি করি যে, সালামুন আলা মোহাম্মদ কখনো কি কেয়ামতের দিনে / বিচারের দিনে আমাদের জন্য সুপারিশ করবেন কিনা ?????????????

অধিকাংশ “সুন্নী , শিয়া , সুফি” বিশ্বাস করে যে হাশরের দিনে সালামুন আলা মুহাম্মদ এবং ঈমাম, পীর, নিজ নিজ উম্মত ও অনুসারীদের মাঝে যারা পাপী তাদের জন্য সুপারিশ করে বেহেস্ত পাইয়ে দেবেন| এভাবেই তারা কুরআনে শেষ দিবসের যে বর্ণনা পাওয়া যায় তাকে বিকৃত করে, ঈমাম ও পীর সুফিদের এমন ভাবে বাজারজাত করে যেন আল্লাহ নন বরং পীর পয়গম্বররাই বিচার দিবসের নিয়ন্ত্রা..!!

সত্য হলো, এই বিশ্বাস শেষ বিচার দিবসে আল্লাহর একচ্ছত্র ক্ষমতাকে খর্ব করার সামিলই শুধু নয় , এই বিশ্বাস কুরআনের বহু আয়াতকে অস্বীকার ও নিষ্কৃয় করে দেয়|

1.আর কিয়ামতের দিন আমি ন্যায়বিচারের মানদন্ড স্থাপন করব। সুতরাং কারো প্রতি কোন অবিচার করা হবে না। কারো কর্ম যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয়, আমি তা হাযির করব। আর হিসাব গ্রহণকারীরূপে আমিই যথেষ্ট।(21:47)

2.সেদিন কেউ কারও জন্য কিছু করার মালিক হবে না; আর সেদিন সব বিষয়ের কর্তৃত্ব হবে আল্লাহর।(82:19)

আজকের মুসলমানদের নৈতিক অধঃপতনের মূলেও এই ভ্রান্ত বিশ্বাস| কেন তারা সৎ, ভাল নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হওয়ার চেষ্টা করবে , যখন তারা নিশ্চিত জানে মুসলমান হওয়ার সুবাদে বা রাসূলের সুন্নত পালন করার কারনে বা ঈমামের বা পীরের অনুসারী হওয়ার সুবাদে পরকালে তাদের কিছুই হবে না, পীর পয়গম্বররা সুপারিশ করে তাদের দোযখে যাওয়ার বদলে বেহেস্তে পাঠাবে| এদের অবস্থা সেই সকল ছাত্রের মতো, যারা সারা বছর পড়াশুনা না করে টুকে বা ঘুষ দিয়ে পাশ করতে চায়|

ইসলামে শাফায়াতের সূচনা :

কুরআনের আয়াত দৃঢ়রুপে ঘোষনা দেয় যে , ইহকাল ও পরকালের ভবিষ্যত সম্পর্কে আধ্যাত্মিক কোন জ্ঞান মুহাম্মদ রাসূলের ছিল না| এমনকি নিজের ভাল ভাল বা মন্দ করার ক্ষমতাও তার ছিল না|

1.বল, ‘আমি রাসূলদের মধ্যে নতুন নই। আর আমি জানি না আমার ও তোমাদের ব্যাপারে কী করা হবে। আমার প্রতি যা ওহী করা হয়, আমি কেবল তারই অনুসরণ করি। আর আমি একজন সুস্পষ্ট সতর্ককারী মাত্র’। অতএব তুমি ধৈর্যধারণ কর, যেমন ধৈর্যধারণ করেছিল সুদৃঢ় সংকল্পের অধিকারী রাসূলগণ। আর তাদের জন্য তাড়াহুড়া করো না। তাদেরকে যে বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছিল, যেদিন তারা তা প্রত্যক্ষ করবে, মনে হবে তারা পৃথিবীতে এক দিনের কিছু সময় অবস্থান করেছে। সুতরাং এটা এক ঘোষণা, তাই পাপাচারী কওমকেই ধ্বংস করা হবে।(46:9,35)

2.বল, আমি তোমাদেরকে বলি না যে, আমার কাছে আল্লাহর ধন-ভান্ডার আছে, আর আমি অদৃশ্যের খবরও জানি না। আর আমি তোমাদেরকে এ কথাও বলি না যে, আমি ফেরেশতা, আমার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয় তাছাড়া (অন্য কিছুর) আমি অনুসরণ করি না। বল, অন্ধ আর চোখওয়ালা কি সমান, তোমরা কি চিন্তা করে দেখ না? তুমি এর (কুরআন) সাহায্যে ঐ সব লোককে ভীতি প্রদর্শন কর যারা ভয় করে যে, তাদেরকে তাদের রবের কাছে এমন অবস্থায় সমবেত করা হবে যেখানে তিনি ছাড়া তাদের না কোন সাহায্যকারী থাকবে, আর না থাকবে কোন সুপারিশকারী, হয়ত তারা সাবধান হবে। আর তুমি তাড়িয়ে দিয়ো না তাদেরকে, যারা নিজ রবকে সকাল সন্ধ্যায় ডাকে, তারা তার সন্তুষ্টি চায়। তাদের কোন হিসাব তোমার উপর নেই এবং তোমার কোন হিসাব তাদের উপর নেই, ফলে তুমি তাদেরকে তাড়িয়ে দিবে এবং তুমি যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে।আর এভাবেই আমি এককে অন্যের দ্বারা পরীক্ষা করেছি, যাতে তারা বলে, ‘এরাই কি, আমাদের মধ্য থেকে যাদের উপর আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন? আল্লাহ কি কৃতজ্ঞদের ব্যাপারে পূর্ণ জ্ঞাত নয়? আমার আয়াতসমূহের উপর বিশ্বাস স্থাপনকারীরা যখন তোমার নিকট আসে তখন তাদেরকে বলঃ তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক, তোমাদের রব নিজের উপর দয়া ও অনুগ্রহ করার নীতি বাধ্যতামূলক করে নিয়েছেন। তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি অজ্ঞতা ও মূর্খতাবশতঃ কোন খারাপ কাজ করে, অতঃপর সে যদি তাওবাহ করে এবং নিজেকে সংশোধন করে তাহলে জানবে যে, তিনি হচ্ছেন ক্ষমাপরায়ণ, করুণাময়। আর এভাবেই আমি আয়াতসমূহ বিস্তারিত বর্ণনা করি। আর যাতে অপরাধীদের পথ স্পষ্ট হয়ে যায়। (6:50-55)

3.বল, ‘আমি আমার নিজের কোন উপকার ও ক্ষতির ক্ষমতা রাখি না, তবে আল্লাহ যা চান। আর আমি যদি গায়েব জানতাম তাহলে অধিক কল্যাণ লাভ করতাম এবং আমাকে কোন ক্ষতি স্পর্শ করত না। আমিতো একজন সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা এমন কওমের জন্য, যারা বিশ্বাস করে’।(7:188)

4.বল, ‘আমি নিজের ক্ষতি বা উপকারের অধিকার রাখি না, তবে আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন’। প্রত্যেক উম্মতের রয়েছে নির্দিষ্ট একটি সময়। যখন এসে যায় তাদের সময়, তখন এক মুহূর্ত পিছাতে পারে না এবং এগোতেও পারে না। (10:49)

5.আর আমি তোমাদেরকে বলছি না যে, আমার নিকট আল্লাহর ধন-ভান্ডার আছে। আমি অদৃশ্যের কথাও জানি না। আর আমি এটাও বলি না যে, আমি ফিরিশতা। আর যারা তোমাদের চোখে হীন, আমি তাদের সম্বন্ধে এটা বলি না যে, আল্লাহ কখনো তাদেরকে কোন মঙ্গল দান করবেন না; তাদের অন্তরে যা কিছু আছে, তা আল্লাহ উত্তমরূপে জানেন। (এরূপ বললে) আমি অবশ্যই যালেমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব।’(11:31)

ফলে “সালামুন আলা মুহাম্মদ” যে শাফায়াত সম্পর্কে কখনো কিছু বলেন’নি , তা নিশ্চিতরুপে বলা যায়| তাই মুহাম্ম রাসূলের নামে প্রচলিত তথাকথিত হাদিসগ্রন্থগুলিতে শাফায়াত নিয়ে লিখিত কল্প কাহিনীগুলো যে সর্বৈব মিথ্যা তা নিঃসন্দেহে বলা যায়| শাফায়াত নিয়ে কুরআনে ও হাদিসে যে বর্ণনা পাই , তা পরষ্পর বিরোধী এবং এদের ভিতরে সমন্বয় করা অসম্ভব|

কুরআনিক আয়াত ১:৪ অনুসারে বিচার দিবসের একমাত্র মালিক আল্লাহ এবং মুহাম্মদ রাসূল আর সকলেরমতোই নশ্বর মনুষ্য আত্মা…

:বলুনঃ আমি ও তোমাদের মতই একজন মানুষ, আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হয় যে, তোমাদের ইলাহ’ই একমাত্র ইলাহ। অতএব, যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সাক্ষাত কামনা করে, সে যেন, সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং তার পালনকর্তার এবাদতে কাউকে শরীক না করে। (১৮:১১০”)

শেষ দিবস নিয়ে কুরআনের এই আয়াত আর সকল আত্মার মতোই মুহাম্মদ রাসূলের জন্যেও প্রযোজ্য…
“যেদিন কেউ কারও কোন উপকার করতে পারবে না এবং সেদিন সব কর্তৃত্ব হবে আল্লাহর।৮২:১৯” |

একারনে আল্লাহ সালামুন আলা মুহাম্মদকেবলেছেন..
“হয় আল্লাহ তাদের ক্ষমা করবেন কিংবা তাদেরকে আযাব দেবেন। এ ব্যাপারে আপনার কোন করণীয় নাই। কারণ তারা রয়েছে অন্যায়ের উপর। (৩:১২৮)
বিচার দিবসের একমাত্র মালিক কর্তা যখন কোন রায় দেবেন, তা যে রদ বদল হবেনা আমরা সেটা জানতে পারি নিম্মের আয়াত থেকে..
“আমার কাছে কথা রদবদল হয় না এবং আমি বান্দাদের প্রতি জুলুমকারী নই। (৫০:২৯”)

যদি কেউ ধারনা করে থাকে যে, শেষ বিচারে আল্লাহ কাউকে দোযখে পাঠানোর রায় দেন এবংমুহাম্মদ বা অন্য কেউ সুপারিশ করে সে রায় পরিবর্তন করে তাকে বাচিয়ে দেবেন , তাহলে সে কুরআন অস্বীকার করার পাঁপে পাঁপী হবে| যার জন্য দোযখের রায় হয়ে গেছে , তার জন্য সুপারিশ করে কেউ তাকে বাচাতে পারবে না কারন আল্লাহ বলেছেন…

“যার জন্যে শাস্তির হুকুম অবধারিতহয়ে গেছে আপনি কি সে জাহান্নামীকে মুক্ত করতে পারবেন? (৩৯:১৯”)

কুরআনে কখনোই শেষ বিচার দিবসে মুহাম্মদের বিশেষ কোন ভূমিকার কথা বলা হয় নি , বরং অন্য আর সকলের মতোই মুহাম্মদকেও বিচারের সম্মুখীন হতে হবে এবং নিম্নের এই আয়াত মুহাম্মদ ও অন্য আর সকল রসূল পয়গম্বরদের জন্য ও প্রযোজ্য..

“সেদিন পলায়ন করবে মানুষ তার ভ্রাতার কাছ থেকে, তার মাতা, তার পিতা, তার পত্নী ও তার সন্তানদের কাছ থেকে। সেদিন প্রত্যেকেরই নিজের এক চিন্তা থাকবে, যা তাকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখবে। (৮০:৩৪-৩৭”)

সুতরাং সেদিন মুহাম্মদ রাসূল বা অন্য কারো শাফায়াত দুরে থাক , অন্য কারোর জন্য চিন্তা করার সময় ও সুযোগ কোনটাই থাকবেনা| আল্লাহ সমগ্র মানবজাতিকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন..

“হে মানব জাতি! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর এবং ভয় কর এমন এক দিবসকে, যখন পিতা পুত্রের কোন কাজে আসবে না এবং পুত্রও তার পিতার কোন উপকার করতে পারবে না। নিঃসন্দেহে আল্লাহর
ওয়াদা সত্য। অতএব, পার্থিব জীবন যেন তোমাদেরকে ধোঁকা না দেয় এবং আল্লাহ সম্পর্কে প্রতারক শয়তানও যেন তোমাদেরকে প্রতারিত না করে। (৩১:৩৩”)

“সালামুন আলা মুহাম্মদ” সেদিন তার উম্মত দুরে থাক, নিজের সন্তানদের কোন উপকারে আসবেন না|
এটা ভাবা অযৌক্তিক যে.. মুহাম্মদ অন্যের বিচারে হস্তক্ষেপ করবেন , যখন তিনি নিজে আর সকল রসূলদের মতোই বিচারের সম্মুখীন হবেন, জিজ্ঞাসিত হবেন|

“অতএব, আমি অবশ্যই তাদেরকে জিজ্ঞেস করব যাদের কাছে রসূল প্রেরিত হয়েছিল এবং অবশ্যই জিজ্ঞেস করব রসূলগণকে। (৭:৬”) মুহাম্মদকে ও বিচারের আওতা থেকেবাদ দেয়া হবে না|
“এটা আপনার ও আপনার সম্প্রদায়ের জন্যে স্মরনিকা এবং শীঘ্রই আপনারা জিজ্ঞাসিত হবেন|(৪৩:৪৪”)

বর্তমানের মুসলমানরা যাদের সাথে মুহাম্মদ রাসূলের কখনো সাক্ষাৎ হয়নি তাদের কথা বাদই দিলাম, যারা তার সমসাময়িক সেই মুসলমানদেরও তিনি কোন কাজে আসবেন না…

“আর তাদেরকে বিতাড়িত করবেন না যারা সকাল-বিকাল স্বীয় পালকর্তার এবাদত করে, তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে। তাদের হিসাব বিন্দুমাত্রও আপনার দায়িত্বে নয় এবং আপনার হিসাব বিন্দুমাত্রও তাদের দায়িত্বে নয় যে, আপনি তাদেরকে বিতাড়িত করবেন। নতুবা আপনি অবিচারকারীদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাবেন। (৬:৫২”)

আল্লাহ ন্যায় বিচারক ও সর্বজ্ঞ| সুপারিশের মাধ্যমে বিচারের রায় পরিবর্তন করা গেলে , সে বিচার ন্যায় বিচার নয়|
” আমি কেয়ামতের দিন ন্যায়বিচারের মানদন্ড স্থাপন করব। সুতরাং কারও প্রতি জুলুম হবে না।যদি কোন আমল সরিষার দানা পরিমাণও হয়, আমি তা উপস্থিত করব এবং হিসাব গ্রহণের জন্যে আমিই
যথেষ্ট। (২১:৪৭”) আর সে দিনের ভয় কর, যখন কেউ কারও সামান্য উপকারে আসবে না এবং তার পক্ষে কোন সুপারিশও কবুল হবে না; কারও কাছ থেকেক্ষতিপূরণও নেয়া হবে না এবং তারা কোন রকম সাহায্যও পাবে না। (২:৪৮”)
“হে ঈমানদারগণ! আমি তোমাদেরকে যে রুযী দিয়েছি, সেদিন আসার পূর্বেই তোমরা তা থেকে ব্যয় কর, যাতে না আছে বেচা-কেনা, না আছে সুপারিশ কিংবা বন্ধুত্ব। আর কাফেররাই হলো প্রকৃত যালেম।
(২:২৫৪”)

“তোমরা ভয় কর সেদিনকে, যে দিন এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তি বিন্দুমাত্র উপকৃত হবে না, কারও কাছ থেকে বিনিময় গৃহীত হবে না, কার ওসুপারিশ ফলপ্রদ হবে না এবং তারা সাহায্য প্রাপ্ত ও হবে না। (২:১২৩”)
“আমি কি তাঁর পরিবর্তে অন্যান্যদেরকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করব? করুণাময় যদি আমাকে কষ্টে নিপতিত করতে চান, তবে তাদের সুপারিশ আমার কোনই কাজে আসবে না এবং তারা আমাকে রক্ষাও করতে পারবে না। ৩৬:২৩”

“বল- শাফা‘আত সম্পূর্ণ আল্লাহর ইখতিয়ারভুক্ত। আকাশ ও পৃথিবীর রাজত্ব তাঁরই, অতঃপর তাঁর কাছেই তোমাদেরকে ফিরিয়ে আনা হবে।” (QS. Az-Zumar 39: Verse 44)

কুরআনের শাফায়াত সংক্রান্ত আরও কিছু আয়াত নিয়ে আলোচনা করার আগে চলুন উত্তর খোঁজা যাক “সূরা মারইয়াম:19/87 – যে দয়াময় আল্লাহর কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছে সে ব্যতীত আর কেউ সুপারিশ করার অধিকারী হবে না”| এর উত্তর জানলে রুপক আয়াতগুলো বুঝতে সুবিধা হবে। কে বা কারা শেষ বিচার দিবসে সুপারিশের অধিকারী হবে? কুরানের সুস্পষ্ট আয়াত অনুযায়ী এরা হলেন – ফেরেশতারা|

“আকাশে অনেক ফেরেশতা রয়েছে। তাদের কোন সুপারিশ ফলপ্রসূ হয় না যতক্ষণ আল্লাহ যার জন্যে ইচ্ছা ও যাকে পছন্দ করেন, অনুমতি না দেন। (৫৩:২৬”)

কেন শুধু ফেরেশতারাই সুপারিশের অধিকারী হবেন সেটা জানার আগে চলুন জানা যাক কেন নবী রসূল সহ কোন মানুষ সুপারিশের অধিকারী হবেন না বা সুপারিশ করার যোগ্যতা রাখেন না বা নিজেকে ছাড়া অন্যকে নিয়ে ভাবনা চিন্তা করার সময় ও সুযোগ কোনটাই নেই| শেষ বিচার দিবসে মানুষের না থাকবে কোন সাহায্যকারী , না থাকবে কোন সুপারিশকারী| তারা একাই বিচারের সম্মুখীন হবে| সেদিন আল্লাহ বলবেন…

“তোমরা আমার কাছে নিঃসঙ্গ হয়ে এসেছ, যেমন আমি প্রথমবার তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছিলাম। আমি তোমাদেরকে যা দিয়েছিলাম, তা পশ্চাতেই রেখে এসেছ। আমি তো তোমাদের সাথে তোমাদের সুপারিশকারীদের কে দেখছি না। যাদের সম্পর্কে তোমাদের দাবী ছিল যে, তারা তোমাদের ব্যাপারে অংশীদার। বাস্তুবিকই তোমাদের পরস্পরের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে এবং তোমাদের দাবী উধাও হয়ে গেছে। (৬:৯৪)

এর অর্থ দাড়ায় সামাজিক প্রতিপত্তি , ধণ সম্পদ , সন্তান সন্ততি , আত্মীয় স্বজন, সুপারিশকারী কেউইসেদিন সঙ্গে থাকবে না| শুধু তাই নয় নিজের চিন্তায় এমনই ব্যতিব্যাস্ত থাকবে যে এদের থেকে পালিয়ে যাবে…
“সেদিন পলায়ন করবে মানুষ তার ভ্রাতার কাছ থেকে, তার মাতা, তার পিতা, তার পত্নী ও তার সন্তানদের কাছ থেকে। সেদিন প্রত্যেকেরই নিজের এক চিন্তা থাকবে, যা তাকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখবে। (৮০:৩৪-৩৭”)
নবী রসূলদের ও পিতা মাতা পত্নী সন্তান সন্ততী ছিল| তারা ও অন্যান্য মানুষের মতোই পালাবে| তারাও অন্যান্য মানুষের মতোই আল্লাহর দাস, তারাও একাকি উত্থিত হবে….
“নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডলে কেউ নেই যে, দয়াময় আল্লাহর কাছে দাস হয়ে উপস্থিত হবে না। তাঁর কাছে তাদের পরিসংখ্যান রয়েছে এবং তিনি তাদেরকে গণনা করে রেখেছেন। কেয়ামতের দিন তাদের সবাই তাঁর
কাছে একাকী অবস্থায় আসবে। (১৯:৯৩-৯৫”)

সেদিন প্রতিটি মানব আত্মা নিজের ওকালতি নিজেই করবে….
“যেদিন প্রত্যেক ব্যক্তি আত্ন-সমর্থনে সওয়াল জওয়াব করতে করতে আসবে এবং প্রত্যেক ব্যক্তি তাদের কৃতকর্মের পূর্ণ ফল পাবে এবং তাদের উপর জুলুম করা হবে না। (১৬:১১১”)

প্রত্যেক ব্যাক্তির সঙ্গে কে থাকবে ও সুপারিশ করবে বা সেই সুপারিশের ফল কী? সুস্পষ্ট কুরআনের আয়াতগুলো থেকে জানলাম – শেষ বিচারের দিনে সকল মানুষ একাকি নিঃসঙ্গভাবে উদভ্রান্তের মতো পালিয়ে বেড়াবে এবং শুধুমাত্র নিজের ভবিষ্যত চিন্তায় ব্যাতিব্যাস্ত থাকবে| এরপরেও যারা এখনো ভাবছেন আল্লাহ মুহাম্মদকে তাদের জন্য সুপারিশ করার অনুমতি দেবেন তাদের জন্য.. এই আয়াতগুলোর শুরুতেই ‘সালামুন আলা মুহাম্মদ’কে আল্লাহ তিরস্কার করছেন তার যুদ্ধের সঙ্গী নিকটস্ত কিছু সাহাবির পক্ষে বিতর্ক করার জন্য|

“নিশ্চয় আমি আপনার প্রতি সত্য কিতাব অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি মানুষের মধ্যে ফয়সালা করেন, যা আল্লাহ আপনাকে হৃদয়ঙ্গম করান। আপনি বিশ্বাসঘাতকদের পক্ষ থেকে বিতর্ককারী হবেন না। এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু। যারা মনে বিশ্বাস ঘাতকতা পোষণ করে তাদের পক্ষ থেকে বিতর্ক করবেন না আল্লাহ পছন্দ করেন না তাকে, যে বিশ্বাস ঘাতক পাপী। (৪:১০৫-১০৭”)
এর পরের আয়াতে এই বিশ্বাস ঘাতক পাপীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ জানিয়ে তিনি সালামুন আলা মুহাম্মদকে আবার ও তিরস্কার করে বলছেন….
“শুনছ? তুমি তাদের পক্ষ থেক পার্থিব জীবনে বিতর্ক করছ, অতঃপর কেয়ামতের দিনে তাদের পক্ষ হয়ে আল্লাহর সাথে কে বিতর্ক করবে অথবা কে তাদের উকিল হবে? (৪:১০৯”)

ভাবুন একবার. সাহাবিদের জন্যেও সালামুন আলা মুহাম্মদের ওকালতি করার অনুমতি নেই , না ইহ জীবনে না পরকালে , সেখানে অন্যান্য মুসলমানেরা কিভাবে সালামুন আলা মুহাম্মদের শাফায়াতের আশা করতে পারে..??

1.আর কিয়ামতের দিন আমি ন্যায়বিচারের মানদন্ড স্থাপন করব। সুতরাং কারো প্রতি কোন অবিচার করা হবে না। কারো কর্ম যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয়, আমি তা হাযির করব। আর হিসাব গ্রহণকারীরূপে আমিই যথেষ্ট।(21:47)

2.সেদিন কেউ কারও জন্য কিছু করার মালিক হবে না; আর সেদিন সব বিষয়ের কর্তৃত্ব হবে আল্লাহর।(82:19)

3.নিশ্চয় সৎকর্মপরায়ণরা থাকবে সুখ- স্বাচ্ছন্দ্যে। আর নিশ্চয় অন্যায়কারীরা থাকবে প্রজ্জ্বলিত আগুনে। তারা বিচার দিবসে সেখানে প্রবেশ করবে। এবং তারা সেখান হতে বের হতে পারবে না। আর কিসে তোমাকে জানাবে কর্মফল দিন কী? আবার বলি, তুমি কি জান কর্মফলের দিনটি কী ? সেদিন কোন মানুষ অন্য মানুষের জন্য কোন কিছুর ক্ষমতা রাখবে না। আর সেদিন সকল বিষয় হবে আল্লাহর কর্তৃত্বে।(82:13-19)

4.আল্লাহ, যিনি আসমান ও যমীন এবং এ দু’য়ের মধ্যে যা কিছু আছে, তা ছয়দিনে সৃষ্টি করেছেন। তারপর তিনি আরশের উপর উঠেছেন। তিনি ছাড়া তোমাদের জন্য কোন অভিভাবক নেই এবং নেই কোন সুপারিশকারী। তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না?(32:4)

5.আর তোমরা সে দিনকে ভয় কর, যেদিন কেউ কারো কোন কাজে আসবে না। আর কারো পক্ষ থেকে কোন সুপারিশ গ্রহণ করা হবে না এবং কারও কাছ থেকে কোন বিনিময় নেয়া হবে না। আর তারা সাহায্যপ্রাপ্তও হবে না।(2:48)

6.আর তোমরা ভয় কর সেদিনকে, যেদিন কেউ কারো কোন কাজে আসবে না এবং কোন ব্যক্তি থেকে বিনিময় গ্রহণ করা হবে না আর কোন সুপারিশ তার উপকারে আসবে না এবং তারা সাহায্যপ্রাপ্তও হবে না।(2:123)

7.হে বিশ্বাসীগণ! আমি তোমাদেরকে যে রুযী দান করেছি, তা থেকে তোমরা দান কর, সেই দিন আসার পূর্বে, যেদিন কোন প্রকার ক্রয়-বিক্রয়, বন্ধুত্ব এবং সুপারিশ থাকবে না। আর অবিশ্বাসীরাই সীমালংঘনকারী।(2:254)

8.আর তিনি বরকতময়, যার কর্তৃত্বে রয়েছে আসমানসমূহ, যমীন ও এ দু’য়ের মধ্যবর্তী সবকিছু; আর কিয়ামতের জ্ঞান কেবল তাঁরই আছে এবং তাঁরই নিকট তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে। আর তিনি ছাড়া যাদেরকে তারা আহবান করে তারা সুপারিশের মালিক হবে না; তবে তারা ছাড়া যারা জেনে-শুনে সত্য সাক্ষ্য দেয় ।(43:85,86)

9.আর তারা আল্লাহ ছাড়া এমন কিছুর ইবাদত করছে, যা তাদের ক্ষতি করতে পারে না এবং উপকারও করতে পারে না। আর তারা বলে, ‘এরা আল্লাহর নিকট আমাদের সুপারিশকারী’। বল, ‘তোমরা কি আল্লাহকে আসমানসমূহ ও যমীনে থাকা এমন বিষয়ে সংবাদ দিচ্ছ যা তিনি অবগত নন’? তিনি পবিত্র মহান এবং তারা যা শরীক করে, তা থেকে তিনি অনেক ঊর্ধ্বে।(10:18)

10.আর যদি তুমি দেখতে, যখন যালিমরা মৃত্যু কষ্টে থাকে, এমতাবস্থায় ফেরেশতারা তাদের হাত প্রসারিত করে আছে (তারা বলে), ‘তোমাদের জান বের কর। আজ তোমাদেরকে প্রতিদান দেয়া হবে লাঞ্ছনার আযাব, কারণ তোমরা আল্লাহর উপর অসত্য বলতে এবং তোমরা তার আয়াতসমূহ সম্পর্কে অহঙ্কার করতে।আর নিশ্চয় তোমরা এসেছ আমার কাছে একা একা, যেরূপ সৃষ্টি করেছি আমি তোমাদেরকে প্রথমবার এবং আমি তোমাদেরকে যা দান করেছি, তা তোমরা ছেড়ে রেখেছ তোমাদের পিঠের পেছনে। আর আমি তোমাদের সাথে তোমাদের সুপারিশকারীদের দেখছি না, যাদের তোমরা মনে করেছ যে, নিশ্চয় তারা তোমাদের মধ্যে আল্লাহর অংশীদার। অবশ্যই ছিন্ন হয়ে গেছে তোমাদের পরস্পরের সম্পর্ক। আর তোমরা যা ধারণা করতে, তা তোমাদের থেকে হারিয়ে গিয়েছে।(6:93,94)

11.বল, ‘তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে ইলাহ মনে করতে তাদেরকে আহবান কর। তারা আসমানসমূহ ও যমীনের মধ্যে অণু পরিমাণ কোন কিছুর মালিক নয়। আর এ দু’য়ের মধ্যে তাদের কোন অংশীদারিত্ব নেই এবং তাদের মধ্য থেকে কেউ তাঁর সাহায্যকারীও নয়। আর আল্লাহ যাকে অনুমতি দেবেন সে ছাড়া তাঁর কাছে কোন সুপারিশ কারো উপকার করবে না। অবশেষে যখন তাদের অন্তর থেকে ভয় বিদূরিত হবে তখন তারা বলবে, ‘তোমাদের রব কী বলেছেন’? তারা বলবে, ‘সত্যই বলেছেন’ এবং তিনি সুমহান ও সবচেয়ে বড়।(34:22,23)

12.সেদিন তারা আহ্বানকারীর অনুসরণ করবে, এ ব্যাপারে এদিক ওদিক করতে পারবে না। আর দয়াময়ের সামনে সমস্ত শব্দ স্তব্ধ হয়ে যাবে; কাজেই মৃদু ধ্বনি ছাড়া তুমি কিছুই শুনবেন না। দয়াময় যাকে অনুমতি দেবেন ও যার কথায় তিনি সন্তুষ্ট হবেন, সে ছাড়া কারো সুপারিশ সেদিন কোন কাজে আসবে না। তাদের সম্মুখে ও পশ্চাতে যা কিছু আছে, তা তিনি অবগত, কিন্তু তারা জ্ঞান দ্বারা তাঁকে বেষ্টন করতে পারে না। (20:108 110)

13.যে পরম দয়াময়ের নিকট প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছে, সে ছাড়া অন্য কারো সুপারিশ করবার ক্ষমতা থাকবে না।(19:87)

14.বস্তুতঃ ইহকাল ও পরকাল আল্লাহরই। আকাশমন্ডলীতে কত ফিরিশতা রয়েছে তাদের কোন সুপারিশ ফলপ্রসূ হবে না, যতক্ষণ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা এবং যার প্রতি সন্তুষ্ট তাকে অনুমতি না দেন। যারা পরকালে বিশ্বাস করে না, তারাই ফিরিশতাদেরকে নারী-বাচক নাম দিয়ে থাকে।অথচ এ বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞান নেই, তারা শুধু অনুমানের অনুসরণ করে। আর সত্যের মুকাবিলায় অনুমানের কোনই মূল্য নেই।(53:25-28)

15.আর তারা বলে, দয়াময় আল্লাহ সন্তান গ্ৰহণ করেছেন। তিনি পবিত্র মহান! তারা তো তার সম্মানিত বান্দা। তারা তাঁর আগে বেড়ে কথা বলে না; তারা তো তাঁর আদেশ অনুসারেই কাজ করে থাকে।তাদের সামনে ও পেছনে যা কিছু আছে তা সবই তিনি জানেন। আর তারা সুপারিশ করে শুধু তাদের জন্যই যাদের প্ৰতি তিনি সন্তুষ্ট এবং তারা তার ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত।(21:26-28)

16.আর আমার কি যুক্তি আছে যে, যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং যাঁর কাছে তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে, আমি তার ইবাদাত করব না? আমি কি তাঁর পরিবর্তে অন্য ইলাহ গ্ৰহণ করব? রহমান আমার কোন ক্ষতি করতে চাইলে তাদের সুপারিশ আমার কোন কাজে আসবে না এবং তারা আমাকে উদ্ধার করতেও পারবে না।এরূপ করলে অবশ্যই স্পষ্ট বিভ্ৰান্তিতে পড়ব। নিশ্চয় আমি তোমাদের রবের উপর বিশ্বাস করেছি, অতএব তোমরা আমার কথা শোন। (36:22-25)

17.তারা বলবে,হে জাহান্নামের অধিবাসীরা,) তোমাদের আজ কিসে এ ভয়াবহ আযাবে উপনীত করেছে? তারা বলবে, আমরা মুসল্লীনদের (সাহায্যকারীদের , সৎ কর্মশীলদের, দায়িত্ব-কর্তব্য পালনকারীদের, দায়িত্বশীলদের, রবের বিধান পালনকারীদের, রবের বিধান বাস্তবায়নকারীদের) অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না। অভাবগ্রস্থকে আহার্য দিতাম না। অহেতুক কাজে মগ্ন থাকতাম।কর্মফল দিবস অস্বীকার করতাম।এমনকি আমাদের নিকট নিশ্চিত বিশ্বাস (অর্থাৎ মৃত্যু) না আসা পর্যন্ত। ফলে সুপারিশকারীদের সুপারিশ তাদের কোন কাজে আসবে না। (74:42—48)

18.তারা কি শুধু তার পরিণামের অপেক্ষা করছে? যেদিন তার পরিণাম প্রকাশ হবে, তখন পূর্বে যারা তাকে ভুলে ছিল, তারা বলবে, ‘আমাদের রবের রাসূলগণ তো সত্য নিয়ে এসেছিলেন। সুতরাং আমাদের জন্য কি সুপারিশকারীদের কেউ আছে, যে আমাদের জন্য সুপারিশ করবে, কিংবা আমাদের প্রত্যাবর্তন করানো হবে, তারপর আমরা যা করতাম তা ভিন্ন অন্য আমল করব’? তারা তো নিজদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং তারা যে মিথ্যা রটাত, তা তাদের থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে।(7:53)

19.আর অপরাধীরাই শুধু আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল, পরিণামে আমাদের কোন সুপারিশকারী নেই।‘এবং কোন অন্তরঙ্গ বন্ধুও নেই’।হায়! যদি আমাদের একবার প্রত্যাবর্তনের সুযোগ ঘটত, তাহলে আমরা বিশ্বাসী হয়ে যেতাম! (26:99-102)

20.আর যেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে সে দিন অপরাধীরা হতাশ হয়ে পড়বে। আর আল্লাহর সাথে শরীককৃত তাদের উপাস্যগুলো তাদের জন্য সুপারিশকারী হবে না এবং তারা তাদের শরীককৃত উপাস্যগুলোকে অস্বীকারকারী হবে।আর যেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে সেদিন তারা বিভক্ত হয়ে পড়বে।(30:12-14)

21.বল, ‘আমি তোমাদেরকে এ বলি না যে, আমার নিকট আল্লাহর ধনভান্ডার আছে, অদৃশ্য সম্বন্ধেও আমি অবগত নই এবং তোমাদেরকে এ কথাও বলি না যে, আমি ফিরিশতা। আমার প্রতি যা প্রত্যাদেশ হয় আমি শুধু তারই অনুসরণ করি!’ বল, ‘অন্ধ ও চক্ষুষমান কি সমান? তোমরা কি অনুধাবন কর না?’ যারা ভয় করে যে, তাদের রবের নিকট তাদেরকে এমন অবস্থায় সমবেত করা হবে যে, তিনি ব্যতীত তাদের কোন অভিভাবক বা সুপারিশকারী থাকবে না, তুমি তাদেরকে এ কুরআন দ্বারা সতর্ক কর; হয়তো তারা সাবধান হবে।আর তুমি পরিত্যাগ কর তাদেরকে, যারা নিজদের দীনকে গ্রহণ করেছে খেল-তামাশা রূপে এবং প্রতারিত করেছে যাদেরকে দুনিয়ার জীবন। আর তুমি কুরআন দ্বারা উপদেশ দাও, যাতে কোন ব্যক্তি তার কৃতকর্মের দরুন ধ্বংসের শিকার না হয়, তার জন্য আল্লাহ ছাড়া নেই কোন অভিভাবক এবং নেই কোন সুপারিশকারী। আর যদি সে সব ধরণের মুক্তিপণও দেয়, তার থেকে তা গ্রহণ করা হবে না। এরাই তারা, যারা ধ্বংসের শিকার হয়েছে তাদের কৃতকর্মের দরুন। তাদের জন্য রয়েছে ফুটন্ত পানীয় এবং বেদনাদায়ক আযাব, যেহেতু তারা কুফরী করত। (6:50,51,70)

22.আজ প্রত্যেককে তার কৃতকর্মের ফল দেওয়া হবে; আজ কারও প্রতি যুলুম করা হবে না। নিশ্চয় আল্লাহ হিসাব গ্রহণে তৎপর। আর তুমি তাদের আসন্ন দিন সম্পর্কে সতর্ক করে, যখন দুঃখ কষ্টে তাদের প্রাণ কন্ঠাগত হবে। যালিমদের জন্য কোন অন্তরঙ্গ বন্ধু নেই, যার সুপারিশ গ্রাহ্য হবে এমন কোন সুপারিশকারীও নেই। (40:17-18)
23.তবে কি তারা আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরকে সুপারিশকারী বানিয়েছে? বল, ‘তারা কোন কিছুর মালিক না হলেও এবং তারা না বুঝলেও’? বল, ‘সকল সুপারিশ আল্লাহর মালিকানাধীন। আসমানসমূহ ও যমীনের রাজত্ব একমাত্র তাঁরই। তারপর তোমরা তাঁর কাছেই প্রত্যাবর্তিত হবে’। (39:43,44)

বিচারের দিনে সুপারি সংক্রান্ত আয়াত সমূহ(39:43,44)(32:4) (2:254)(21:47)(82:19)(2:48)(2:123)(6:51)(6:70) (10:3)(2:255)(43:86)(10:18)(20:109)(19:87)(21:28)(53:26)((34:23)(74:48)(6:94)(36:23)(39:44)

(সালামুন আলা নুহু-11:46,66:10)(সালামুন আলা ইব্রাহিম 9:114) (সালামুন আলা লুত-29:32,33,11:81,66:10)(সালামুন আলা ইসা-5:117)(সালামুন আলা মুহাম্মদ 9:80,113)(4:105109)(2:119)(39:19)(3:128)(4:84)(10:41)(34:25)(2:139,141)(43:44)(25:30) (7:188)(6:50)(46:9)(69:43-48)

By AnamulHoqBn

1,2-শাফায়াত (সুপারিশ)

AKSiqdar

.

পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে।

👉 ইসলাম ও শাফায়াত (সুপারিশ), পর্ব ১।

✍✍✍ কোরানিক শিক্ষার বিপরিতে অধিকাংশ মুহাম্মদীরা (সুন্নী , শিয়া , সুফি) বিশ্বাস করে যে হাশরের দিনে মুহাম্মদ (এবং ঈমাম , পীর, সুফি) নিজ নিজ উম্মত ও অনুসারীদের মাঝে যারা পাপী তাদের জন্য সুপারিশ করে বেহেস্ত পাইয়ে দেবেন| এভাবেই তারা কোরানে শেষ দিবসের যে বর্ণনা পাওয়া যায় তাকে বিকৃত করে মুহাম্মদ ,ঈমাম ও পীর সুফিদের এমন ভাবে বাজারজাত করে যেন আল্লাহ নন বরং পীর পয়গম্বররাই বিচার দিবসের নিয়ন্তা| সত্য হলো , এই বিশ্বাস শেষ বিচার দিবসে আল্লাহর একচ্ছত্র ক্ষমতাকে খর্ব করার সামিলই শুধু নয় , এই বিশ্বাস কোরানের বহু আয়াতকে অস্বীকার ও নিষ্কৃয় করে দেয়|

আজকের মুহাম্মদীদের নৈতিক অধঃপতনের মূলেও এই ভ্রান্ত বিশ্বাস| কেন তারা সৎ , ভাল নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হওয়ার চেষ্টা করবে , যখন তারা নিশ্চিত জানে মুসলমান হওয়ার সুবাদে বা সুন্নত পালন করার কারনে বা ঈমামের বা পীরের অনুসারী হওয়ার সুবাদে পরকালে তাদের কিছুই হবে না , পীর পয়গম্বররা সুপারিশ করে তাদের দোযখে যাওয়ার বদলে বেহেস্তে পাঠাবে| এদের অবস্থা সেই সকল ছাত্রের মতো , যারা সারা বছর পড়াশুনা না করে টুকে বা ঘুষ দিয়ে পাশ করতে চায়|

ইসলামে শাফায়াতের সূচনা *

কোরানের আয়াত দৃঢ়রুপে ঘোষনা দেয় যে , ইহকাল ও পরকালের ভবিষ্যত সম্পর্কে আধ্যাত্মিক কোন জ্ঞান মুহাম্মদের ছিল না| এমনকি নিজের ভাল ভাল বা মন্দ করার ক্ষমতাও তার ছিল না|

“আপনি বলে দিন, আমি আমার নিজের কল্যাণ সাধনের এবং অকল্যাণ সাধনের মালিক নই, কিন্তু যা আল্লাহ চান। আর আমি যদি গায়েবের(ভবিষ্যতের) কথা জেনে নিতে পারতাম, তাহলে বহু মঙ্গল অর্জন করে নিতে পারতাম, ফলে আমার কোন অমঙ্গল কখনও হতে পারত না। আমি তো শুধুমাত্র একজন ভীতি প্রদর্শক ও সুসংবাদদাতা ঈমানদারদের জন্য। ৭:১৮৮”

“আপনি বলুনঃ আমি তোমাদেরকে বলি না যে, আমার কাছে আল্লাহর ভান্ডার রয়েছে। তাছাড়া আমি অদৃশ্য বিষয় (ভবিষ্যত) অবগতও নই। আমি এমন বলি না যে, আমি ফেরেশতা। আমি তো শুধু ঐ ওহীর অনুসরণ করি, যা আমার কাছে আসে। আপনি বলে দিনঃ অন্ধ ও চক্ষুমান কি সমান হতে পারে? তোমরা কি চিন্তা কর না ? ৬:৫০”

ফলে মুহাম্মদ যে শাফায়াত সম্পর্কে কখনো কিছু বলেন নি , তা নিশ্চিতরুপে বলা যায়| তাই মুহাম্মদের নামে প্রচলিত তথাকথিত হাদিসগ্রন্থগুলিতে শাফায়াত নিয়ে লিখিত কল্প কাহিনীগুলো যে সর্বৈব মিথ্যা তা নিঃসন্দেহে বলা যায়| শাফায়াত নিয়ে কোরানে ও হাদিসে যে বর্ণনা পাই , তা পরষ্পর
বিরোধী এবং এদের ভিতরে সমন্বয় করা অসম্ভব|

কোরানিক আয়াত ১:৪ অনুসারে বিচার দিবসের একমাত্র মালিক আল্লাহ এবং মুহাম্মদ আর সকলের মতোই নশ্বর মনুষ্য আত্মা…:বলুনঃ আমি ও তোমাদের মতই একজন মানুষ, আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হয় যে, তোমাদের ইলাহই একমাত্র ইলাহ। অতএব, যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সাক্ষাত কামনা করে, সে যেন, সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং তার পালনকর্তার এবাদতে কাউকে শরীক না করে। ১৮:১১০”|

শেষ দিবস নিয়ে কোরানের এই আয়াত আর সকল আত্মার মতোই মুহাম্মদের জন্যেও প্রযোজ্য… “যেদিন কেউ কারও কোন উপকার করতে পারবে না এবং সেদিন সব কর্তৃত্ব হবে আল্লাহর।
৮২:১৯” |
একারনে আল্লাহ মুহাম্মদকে বলেছেন..”হয় আল্লাহ তাদের ক্ষমা করবেন কিংবা তাদেরকে আযাব দেবেন। এ ব্যাপারে আপনার কোন করণীয় নাই। কারণ তারা রয়েছে অন্যায়ের উপর। ৩:১২৮”|

বিচার দিবসের একমাত্র মালিক ও কর্তা যখন কোন রায় দেবেন ,তা যে রদ বদল হবেনা আমরা সেটা জানতে পারি নিম্মের আয়াত থেকে..”আমার কাছে কথা রদবদল হয় না এবং আমি বান্দাদের প্রতি জুলুমকারী নই। ৫০:২৯”|

যদি কেউ ধারনা করে থাকে যে শেষ বিচারে আল্লাহ কাউকে দোযখে পাঠানোর রায় দেন এবং মুহাম্মদ বা অন্য কেউ সুপারিশ করে সে রায় পরিবর্তন করে তাকে বাচিয়ে দেবেন , তাহলে সে কোরান অস্বীকার করার পাঁপে পাঁপী হবে| যার জন্য দোযখের রায় হয়ে গেছে , তার জন্য সুপারিশ করে কেউ তাকে বাচাতে পারবে না| কারন আল্লাহ বলেছেন…

“যার জন্যে শাস্তির হুকুম অবধারিত হয়ে গেছে আপনি কি সে জাহান্নামীকে মুক্ত করতে পারবেন? ৩৯:১৯”

শাফায়াতের হাদীসে বিশ্বাসের অর্থই হলো কোরানের আয়াতকে অস্বীকার করে মুহাম্মদ বা অন্যদেরকে দেবতার আসনে বসানোর সমতুল্য| কারন এদের ধারনা এই দেবতারা আল্লাহর থেকেও দয়ালু এবং এই দেবতারা তাদের ইচ্ছাকে আল্লাহর উপরে চাপিয়ে দিয়ে তার রায় পরিবর্তন করতে সক্ষম|

কোরানে কখনোই শেষ বিচার দিবসে মুহাম্মদের বিশেষ কোন ভূমিকার কথা বলা হয় নি , বরং অন্য আর সকলের মতোই মুহাম্মদকেও বিচারের সম্মুখীন হতে হবে এবং নিম্নের এই আয়াত মুহাম্মদ ও অন্য আর সকল রসূল পয়গম্বরদের জন্য ও প্রযোজ্য…

“সেদিন পলায়ন করবে মানুষ তার ভ্রাতার কাছ থেকে, তার মাতা, তার পিতা, তার পত্নী ও তার সন্তানদের কাছ থেকে। সেদিন প্রত্যেকেরই নিজের এক চিন্তা থাকবে, যা তাকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখবে। ৮০:৩৪-৩৭”

সুতরাং সেদিন মুহাম্মদ বা অন্য কারো শাফায়াত দুরে থাক , অন্য কারোর জন্য চিন্তা করার সময় ও সুযোগ কোনটাই থাকবেনা| আল্লাহ সমগ্র মানবজাতিকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন..

“হে মানব জাতি! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর এবং ভয় কর এমন এক দিবসকে, যখন পিতা পুত্রের কোন কাজে আসবে না এবং পুত্রও তার পিতার কোন উপকার করতে পারবে না। নিঃসন্দেহে আল্লাহর ওয়াদা সত্য। অতএব, পার্থিব জীবন যেন তোমাদেরকে ধোঁকা না দেয় এবং আল্লাহ সম্পর্কে প্রতারক শয়তানও যেন তোমাদেরকে প্রতারিত না করে। ৩১:৩৩”

মুহাম্মদ সেদিন তার উম্মত দুরে থাক, নিজের কন্যা ফাতেমার ও কোন উপকারে আসবেন না| এটা ভাবা অযৌক্তিক যে মুহাম্মদ অন্যের বিচারে হস্তক্ষেপ করবেন , যখন তিনি নিজে আর সকল রসূলদের মতোই বিচারের সম্মুখীন হবেন , জিজ্ঞাসিত হবেন|

“অতএব, আমি অবশ্যই তাদেরকে জিজ্ঞেস করব যাদের কাছে রসূল প্রেরিত হয়েছিল এবং অবশ্যই জিজ্ঞেস করব রসূলগণকে। ৭:৬”

মুহাম্মদকে ও বিচারের আওতা থেকে বাদ দেয়া হবে না|

“এটা (কোরান) আপনার ও আপনার সম্প্রদায়ের জন্যে স্মরনিকা এবং শীঘ্রই আপনারা জিজ্ঞাসিত হবেন| ৪৩:৪৪”

বর্তমানের মুসলমানরা যাদের সাথে মুহাম্মদের কখনো সাক্ষাৎ হয়নি তাদের কথা বাদই দিলাম , যারা তার সমসাময়িক সেই মুসলমানদেরও তিনি কোন কাজে আসবেন না…

“আর তাদেরকে বিতাড়িত করবেন না, যারা সকাল-বিকাল স্বীয় পালকর্তার এবাদত করে, তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে। তাদের হিসাব বিন্দুমাত্রও আপনার দায়িত্বে নয় এবং আপনার হিসাব বিন্দুমাত্রও তাদের দায়িত্বে নয় যে, আপনি তাদেরকে বিতাড়িত করবেন। নতুবা আপনি অবিচারকারীদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাবেন। ৬:৫২”

আল্লাহ ন্যায় বিচারক ও সর্বজ্ঞ| সুপারিশের মাধ্যমে বিচারের রায় পরিবর্তন করা গেলে , সে বিচার ন্যায় বিচার নয়|

“আমি কেয়ামতের দিন ন্যায়বিচারের মানদন্ড স্থাপন করব। সুতরাং কারও প্রতি জুলুম হবে না। যদি কোন আমল সরিষার দানা পরিমাণও হয়, আমি তা উপস্থিত করব এবং হিসাব গ্রহণের জন্যে আমিই যথেষ্ট। ২১:৪৭”

কোরানে যে সকল আয়াতে শাফায়াত (شَفَٰعَ) শব্দটি আছে , সেই আয়াতগুলো দুই রকমের : সুস্পষ্ট ও রুপক| সুস্পষ্ট আয়াতগুলোতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে কোন শাফায়াত নেই| মুহাম্মদীরা রুপক আয়াতগুলোকে ত্যনা পেচিয়ে প্রমাণ করতে চায় শাফায়াত আছে| এ ব্যাপারে কোরানে বলা হয়েছে…

“তিনিই আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছেন। তাতে কিছু আয়াত রয়েছে সুস্পষ্ট, সেগুলোই কিতাবের আসল অংশ। আর অন্যগুলো রূপক। সুতরাং যাদের অন্তরে কুটিলতা রয়েছে, তারা অনুসরণ করে ফিৎনা বিস্তার এবং অপব্যাখ্যার উদ্দেশে তন্মধ্যেকার রূপকগুলোর। আর সেগুলোর ব্যাখ্যা আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানে না। আর যারা জ্ঞানে সুগভীর, তারা বলেনঃ আমরা এর প্রতি ঈমান এনেছি। এই সবই আমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে। আর বোধশক্তি সম্পন্নেরা ছাড়া অপর কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না। ৩:৭”

চলুন সুস্পষ্ট আয়াতগুলো পড়া যাক….

“আর সে দিনের ভয় কর, যখন কেউ কারও সামান্য উপকারে আসবে না এবং তার পক্ষে কোন সুপারিশও কবুল হবে না; কারও কাছ থেকে ক্ষতিপূরণও নেয়া হবে না এবং তারা কোন রকম সাহায্যও পাবে না। ২:৪৮”

“হে ঈমানদারগণ! আমি তোমাদেরকে যে রুযী দিয়েছি, সেদিন আসার পূর্বেই তোমরা তা থেকে ব্যয় কর, যাতে না আছে বেচা-কেনা, না আছে সুপারিশ কিংবা বন্ধুত্ব। আর কাফেররাই হলো প্রকৃত যালেম। ২:২৫৪”

“তোমরা ভয় কর সেদিনকে, যে দিন এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তি বিন্দুমাত্র উপকৃত হবে না, কারও কাছ থেকে বিনিময় গৃহীত হবে না, কার ও সুপারিশ ফলপ্রদ হবে না এবং তারা সাহায্য প্রাপ্ত ও হবে না। ২:১২৩”

“আমি কি তাঁর পরিবর্তে অন্যান্যদেরকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করব? করুণাময় যদি আমাকে কষ্টে নিপতিত করতে চান, তবে তাদের সুপারিশ আমার কোনই কাজে আসবে না এবং তারা আমাকে রক্ষাও করতে পারবে না। ৩৬:২৩”

“বলুন, সমস্ত সুপারিশ আল্লাহরই , আসমান ও যমীনে তাঁরই সাম্রাজ্য। অতঃপর তাঁরই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে। ৩৯:৪৪”

.

পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে।

👉 ইসলাম ও শাফায়াত,পর্ব ২

✍✍✍ কোরানের শাফায়াত সংক্রান্ত রুপক আয়াতগুলো নিয়ে আলোচনা করার আগে চলুন উত্তর খোঁজা যাক গত পোস্টে হামিদুল ইসলাম নামে এক ভাইয়ের করা মন্তব্যের “সূরা মারইয়াম:19/87 – যে দয়াময় আল্লাহর কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছে, সে ব্যতীত আর কেউ সুপারিশ করার অধিকারী হবে না”| এর উত্তর জানলে রুপক আয়াতগুলো বুঝতে সুবিধা হবে|

কে বা কারা শেষ বিচার দিবসে সুপারিশের অধিকারী হবে? কোরানের সুস্পষ্ট আয়াত অনুযায়ী এরা হলেন – ফেরেশতারা|

“আকাশে অনেক ফেরেশতা রয়েছে। তাদের কোন সুপারিশ ফলপ্রসূ হয় না যতক্ষণ আল্লাহ যার জন্যে ইচ্ছা ও যাকে পছন্দ করেন, অনুমতি না দেন। ৫৩:২৬”

কেন শুধু ফেরেশতারাই সুপারিশের অধিকারী হবেন সেটা জানার আগে চলুন জানা যাক কেন নবী রসূল সহ কোন মানুষ সুপারিশের অধিকারী হবেন না বা সুপারিশ করার যোগ্যতা রাখেন না বা নিজেকে ছাড়া অন্যকে নিয়ে ভাবনা চিন্তা করার সময় ও সুযোগ কোনটাই নেই|

শেষ বিচার দিবসে মানুষের না থাকবে কোন সাহায্যকারী , না থাকবে কোন সুপারিশকারী| তারা একাই বিচারের সম্মুখীন হবে| সেদিন আল্লাহ বলবেন…

“তোমরা আমার কাছে নিঃসঙ্গ হয়ে এসেছ, যেমন আমি প্রথমবার তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছিলাম। আমি তোমাদেরকে যা দিয়েছিলাম, তা পশ্চাতেই রেখে এসেছ। আমি তো তোমাদের সাথে তোমাদের সুপারিশকারীদের কে দেখছি না। যাদের সম্পর্কে তোমাদের দাবী ছিল যে, তারা তোমাদের ব্যাপারে অংশীদার। বাস্তুবিকই তোমাদের পরস্পরের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে এবং তোমাদের দাবী উধাও হয়ে গেছে। ৬:৯৪”

এর অর্থ দাড়ায় সামাজিক প্রতিপত্তি , ধণ সম্পদ , সন্তান সন্ততি , আত্মীয় স্বজন , সুপারিশকারী কেউই সেদিন সঙ্গে থাকবে না| শুধু তাই নয় নিজের চিন্তায় এমনই ব্যতিব্যাস্ত থাকবে যে এদের থেকে পালিয়ে যাবে…

“সেদিন পলায়ন করবে মানুষ তার ভ্রাতার কাছ থেকে, তার মাতা, তার পিতা, তার পত্নী ও তার সন্তানদের কাছ থেকে। সেদিন প্রত্যেকেরই নিজের এক চিন্তা থাকবে, যা তাকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখবে। ৮০:৩৪-৩৭”

নবী রসূলদের ও পিতা মাতা পত্নী সন্তান সন্ততী ছিল| তারা ও অন্যান্য মানুষের মতোই পালাবে| তারাও অন্যান্য মানুষের মতোই আল্লাহর দাস , তারাও একাকি উত্থিত হবে….

“নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডলে কেউ নেই যে, দয়াময় আল্লাহর কাছে দাস হয়ে উপস্থিত হবে না। তাঁর কাছে তাদের পরিসংখ্যান রয়েছে এবং তিনি তাদেরকে গণনা করে রেখেছেন। কেয়ামতের দিন তাদের সবাই তাঁর কাছে একাকী অবস্থায় আসবে। ১৯:৯৩-৯৫”

সেদিন প্রতিটি মানব আত্মা নিজের ওকালতি নিজেই করবে….

“যেদিন প্রত্যেক ব্যক্তি আত্ন-সমর্থনে সওয়াল জওয়াব করতে করতে আসবে এবং প্রত্যেক ব্যক্তি তাদের কৃতকর্মের পূর্ণ ফল পাবে এবং তাদের উপর জুলুম করা হবে না। ১৬:১১১”

প্রত্যেক ব্যাক্তির সঙ্গে কে থাকবে ও সুপারিশ করবে বা সেই সুপারিশের ফল কী?

সুস্পষ্ট কোরানের আয়াতগুলো থেকে জানলাম – শেষ বিচারের দিনে সকল মানুষ একাকি নিঃসঙ্গভাবে উদভ্রান্তের মতো পালিয়ে বেড়াবে এবং শুধুমাত্র নিজের ভবিষ্যত চিন্তায় ব্যাতিব্যাস্ত থাকবে| এরপরেও যারা এখনো ভাবছেন আল্লাহ মুহাম্মদকে তাদের জন্য সুপারিশ করার অনুমতি দেবেন তাদের জন্য..

এই আয়াতগুলোর শুরুতেই মুহাম্মদকে আল্লাহ তিরস্কার করছেন তার যুদ্ধের সঙ্গী নিকটস্ত কিছু সাহাবির পক্ষে বিতর্ক করার জন্য|

“নিশ্চয় আমি আপনার প্রতি সত্য কিতাব অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি মানুষের মধ্যে ফয়সালা করেন, যা আল্লাহ আপনাকে হৃদয়ঙ্গম করান। আপনি বিশ্বাসঘাতকদের পক্ষ থেকে বিতর্ককারী হবেন না। এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু। যারা মনে বিশ্বাস ঘাতকতা পোষণ করে তাদের পক্ষ থেকে বিতর্ক করবেন না। আল্লাহ পছন্দ করেন না তাকে, যে বিশ্বাস ঘাতক পাপী। ৪:১০৫-১০৭”

এর পরের আয়াতে এই বিশ্বাস ঘাতক পাপীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ জানিয়ে তিনি মুহাম্মদকে আবার ও তিরস্কার করে বলছেন….

“শুনছ? তুমি তাদের পক্ষ থেকে পার্থিব জীবনে বিতর্ক করছ, অতঃপর কেয়ামতের দিনে তাদের পক্ষ হয়ে আল্লাহর সাথে কে বিতর্ক করবে অথবা কে তাদের উকিল হবে? ৪:১০৯”

ভাবুন একবার..নিকট সাহাবিদের জন্যেও মুহাম্মদের ওকালতি করার অনুমতি নেই , না ইহ জীবনে না পরকালে , সেখানে অন্যান্য মুসলমানেরা কিভাবে মুহাম্মদের শাফায়াতের আশা করতে পারে!!

ইসলাম ও শাফায়াত (সুপারিশ) শেষ…

“তারা কি আল্লাহ ব্যতীত সুপারিশকারী গ্রহণ করেছে? বলুন, তাদের কোন এখতিয়ার না থাকলেও এবং তারা না বুঝলেও? বলুন, সমস্ত সুপারিশ আল্লাহরই ক্ষমতাধীন, আসমান ও যমীনে তাঁরই সাম্রাজ্য। অতঃপর তাঁরই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।” ৩৯:৪৩-৪৪

উপরের এই আয়াত থেকে এটা স্পষ্ট শেষ বিচারের দিনে আল্লাহ ছাড়া কোন সুপারিশকারী নেই| কিন্তু ৫৩:২৬ আয়াত অনুযায়ী “আকাশে অনেক ফেরেশতা রয়েছে। তাদের কোন সুপারিশ ফলপ্রসূ হয় না যতক্ষণ আল্লাহ যার জন্যে ইচ্ছা ও যাকে পছন্দ করেন, অনুমতি না দেন”| তাহলে আয়াত দুটি কি পরষ্পর বিরোধী হয়ে গেল না? না| কারন – ফেরেশতারা নিজের ইচ্ছায় কিছু করেন না , তারা আল্লাহর নির্দেশ ও অনুমতিক্রমেই সব কিছু করেন| এ কারনে ফেরেশতাদের কাজ কে ও আল্লাহর কাজ বলেই ধরা হয়| এটা বুঝতে নিচের আয়াতদুটি দেখুন …

“আল্লাহ মানুষের প্রাণ হরণ করেন তার মৃত্যুর সময়,”… ৩৯:৪২
“বলুন, তোমাদের প্রাণ হরণের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতা তোমাদের প্রাণ হরণ করবে।”৩২:১১

একই যুক্তিতে বলা যায় আল্লাহ যখন কোন ব্যাক্তিকে করুনা করতে চান , তখন ফেরেশতাদের সুপারিশ করার অনুমতি দেন| প্রথম থেকে শুরু করা যাক , আল্লাহ প্রতিটি মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সর্বক্ষনের জন্য দুটি ফেরেশতাকে নিয়োজিত করেছেন তার সকল কর্ম নথীভুক্ত করার জন্য|

“আমি মানুষ সৃষ্টি করেছি এবং তার মন নিভৃতে যে কুচিন্তা করে, সে সম্বন্ধেও আমি অবগত আছি। আমি তার গ্রীবাস্থিত ধমনী থেকেও অধিক নিকটবর্তী। যখন দুই ফেরেশতা ডানে ও বামে বসে তার আমল গ্রহণ করে। সে যে কথাই উচ্চারণ করে, তাই গ্রহণ করার জন্যে তার কাছে সদা প্রস্তুত প্রহরী রয়েছে।” ৫০:১৬-১৮

“অবশ্যই তোমাদের উপর তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত আছে। সম্মানিত আমল লেখকবৃন্দ। তারা জানে যা তোমরা কর। “৮২:১০-১২

শেষ বিচারের দিন সকলেই একাকি উত্থিত হবে ,অর্থাৎ কোন মানব আত্মা তার সঙ্গে থাকবে না| (নবী রসূলরাও মানব আত্মা) শুধু থাকবে দুই ফেরেশতা তাদের সঙ্গে..

“এবং শিঙ্গায় ফুঁৎকার দেয়া হবে এটা হবে ভয় প্রদর্শনের দিন। প্রত্যেক ব্যক্তি আগমন করবে। তার সাথে থাকবে চালক ও কর্মের সাক্ষী। তুমি তো এই দিন সম্পর্কে উদাসীন ছিলে। এখন তোমার কাছ থেকে যবনিকা সরিয়ে দিয়েছি। ফলে আজ তোমার দৃষ্টি সুতীক্ষ্ন। তার সঙ্গী ফেরেশতা বলবেঃ আমার কাছে যে, আমলনামা ছিল, তা এই। তোমরা উভয়েই নিক্ষেপ কর জাহান্নামে প্রত্যেক অকৃতজ্ঞ বিরুদ্ধবাদীকে,”৫০:২০-২৪

বিচার শেষ এবং জাহান্নামে নিক্ষেপ করাও সম্পন্ন| এর ভিতরেই যা করার করতে হবে| আল্লাহর অনুমতি সাপেক্ষে নিজের ওকালতি নিজেকেই করতে হবে এবং সাক্ষী হিসাবে সর্বক্ষনের সঙ্গী এই ফেরেশতারারা ছাড়া আর কেউ থাকবে না| সুতরাং সত্যিকারের সুপারিশ তো এই ফেরেশতারাই করবে আল্লাহর অনুমতি সাপেক্ষে| এদের পক্ষেই করা সম্ভব সুপারিশ করা , কারন এরা তার সকল কাজের সাক্ষী| কোন মানুষের পক্ষে সুপারিশকারী হওয়া সম্ভব নয় , কারন তারা সকল কর্মের সাক্ষী বাস্তবিকভাবে হতে পারে না|

সুতরাং আমরা এই উপসংহারে পৌছাতে পারি যে , আল্লাহ যার উপর করুনা করতে চান তার জন্য ফেরেশতাদের অনুমতি দেবেন তার ভাল কাজের সাক্ষ্য তথা সুপারিশ করতে|

শাফায়াতে কুবরা

কুরআনের আলোকে কথিত “শাফায়াতে কুবরা” (কিঞ্চিৎ পরিমার্জিত)
-আবু সাঈদ খান
*****************************

https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=2757859010913203&id=100000673936418

**************

মুসলিম সমাজে ব্যাপকভাবে একটি বিশ্বাস চালু করে দেয়া হয়েছে যে, ‘হাদীস’ বলতে যা বোঝানো হয়, তা হল কুরআনের ব্যাখ্যা। শাফায়াত বা সুপারিশ সম্পর্কে কুরআনিক শাশ্বত বিবৃতি বহু। একইভাবে শাফায়াত সংক্রান্ত অনেকগুলো বর্ণনা আমরা প্রচলিত ‘হাদীস’ গ্রন্থগুলোতে পাই – এর মধ্যে অন্যতম যেটি, তা ‘শাফায়াতে কুবরা’ বা বড় শাফায়াত নামে পরিচিত। কুরআনে শাফায়াত নিয়ে কোনো আয়াতের বিপরীতে হয়ত এটিকে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে।

শাফায়াত সম্পর্কিত ‘হাদীসের’ বর্ণনায় এমন ‘সহীহ’ দাবীকৃত বিবৃতিও রয়েছে, কিয়ামতের দিন আল্লাহর পক্ষ থেকে জাহান্নাম নির্ধারিত হয়ে গেছে এমন ব্যক্তিকেও আল্লাহর শেষনবী তাঁর কথিত ‘কর্তৃত্ব’ বলে ছাড়িয়ে এনে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দিবেন। যদিও কুরআনে আল্লাহর দাবী সম্পূর্ণ উল্টো।

“আল্লাহ বলবেনঃ আমার সামনে বাকবিতন্ডা করো না আমি তো পূর্বেই তোমাদেরকে আযাব দ্বারা ভয় প্রদর্শন করেছিলাম। আমার কাছে কথা রদবদল হয় না এবং আমি বান্দাদের প্রতি জুলুমকারী নই।” -৫০:২৮-২৯

‘শাফায়াতুন’ পদটি কুরআনে ৩০ বার আবির্ভূত হয়েছে। এর অর্থ একটি কাজের সাথে আর একটি কাজকে যুক্ত করা; একজনের পক্ষ হয়ে কথা বলা, মধ্যস্থতা করা, ইত্যাদি। যেমন.

مَنْ يَشْفَعْ شَفَاعَةً حَسَنَةً يَكُنْ لَهُ نَصِيبٌ مِنْهَا وَمَنْ يَشْفَعْ شَفَاعَةً سَيِّئَةً يَكُنْ لَهُ كِفْلٌ مِنْهَا

যে লোক সৎকাজের জন্য কোন সুপারিশ করবে, তা থেকে সেও একটি অংশ পাবে। আর যে লোক সুপারিশ করবে মন্দ কাজের জন্যে সে তার বোঝারও একটি অংশ পাবে। বস্তুতঃ আল্লাহ সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাশীল। -৪:৮৫

শাফায়াতের পূর্ণ কর্তৃত্ব আল্লাহর

কুরআনে শাফায়াত সম্পর্কিত বিস্তৃত আলোচনা এসেছে। শাফায়াতের পূর্ণ কর্তৃত্ব আল্লাহর (৩৯:৪৪) জানিয়ে বলা হয়েছে যে, কেবলমাত্র সেই সুপারিশ করতে পারবে যাকে অনুমতি দেয়া হবে।

কার জন্য শাফায়াতের অনুমতি দেয়া হবে তার শর্তও বলে দেয়া হয়েছে।

مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ

কে আছ এমন, যে সুপারিশ করবে তাঁর কাছে তাঁর অনুমতি ছাড়া? -২:২৫৫

وَلَا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ عِنْدَهُ إِلَّا لِمَنْ أَذِنَ لَهُ

যার জন্যে অনুমতি দেয়া হয়, তার জন্যে ব্যতীত আল্লাহর কাছে কারও সুপারিশ ফলপ্রসূ হবে না। -৩৪:২৩

يَوْمَئِذٍ لَا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ إِلَّا مَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّحْمَنُ وَرَضِيَ لَهُ قَوْلًا

দয়াময় আল্লাহ যাকে অনুমতি দেবেন এবং যার কথায় সন্তুষ্ট হবেন সে ছাড়া কারও সুপারিশ সেদিন কোন উপকারে আসবে না। -২০:১০৯

مَا مِنْ شَفِيعٍ إِلَّا مِنْ بَعْدِ إِذْنِهِ ذَلِكُمُ اللَّهُ رَبُّكُمْ فَاعْبُدُوهُ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ

কেউ সুপারিশ করতে পারবে না তবে তাঁর অনুমতি ছাড়া; ইনিই আল্লাহ তোমাদের পালনকর্তা। অতএব, তোমরা তাঁরই এবাদত কর। তোমরা কি কিছুই চিন্তা কর না ? -১০:৩

এখানে ‘মান (مَنْ)’ বা যে কেউ বলতে সুনির্দিষ্ট করে কাউকে বোঝায় না। আল্লাহ পছন্দ করেন এমন যে কেউই তিনি হতে পারেন।

বস্তুতঃ পুরো কুরআন থেকে একটি আয়াত দ্বারাও কোনভাবে এটা প্রমাণ করা যাবে না যে, শাফায়াতের বিষয়ে শেষনবীকে অন্যান্যদের চেয়ে আলাদা কোন মর্যাদা, অধিকার বা এখতিয়ার প্রদান করা হয়েছে যা ‘শাফায়াতে কুবরা’ নামক কথিত ‘হাদীসের’ বর্ণনা দ্বারা আমাদের বিশ্বাস ও মননে অনুপ্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়েছে।

কুরআনের যে কোনো আয়াতের ব্যাখ্যা হিসেবেই ‘শাফায়াতে কুবরাকে’ দাড় করানো হোক না কেন, কুরআনের কষ্টিপাথরে যাচাই করলে শেষ পর্যন্ত তা টিকে কিনা তাই আমরা আলোচ্য নিবন্ধে প্রমাণ করতে চেষ্টা করব, ইনশা-আল্লাহ।

কেননা কুরআন আহসানা তাফসীর বা সর্বোত্তম ব্যাখ্যাকারী

কুরআনুল কারীম নিজেই নিজের উত্তম বিশ্লেষণকারী এবং যে কোন বিষয়ের সন্তোষজনক উত্তর প্রদানকারী। কুরআন বিশ্বের যে কোন মানুষের যে কোন ধরণের জিজ্ঞাসার বিপরীতে সর্বোত্তম ব্যাখ্যাকারী বা আহসানা তাফসীরা (أَحْسَنَ تَفْسِيرًا) বা “Best Explanation”।

وَلَا يَأْتُونَكَ بِمَثَلٍ إِلَّا جِئْنَاكَ بِالْحَقِّ وَأَحْسَنَ تَفْسِيرًا

উহারা তোমার নিকট এমন কোন সমস্যা উপস্থিত করে না, যাহার সঠিক সমাধান ও সুন্দর ব্যাখ্যা আমি তোমাকে প্রদান করি না। -২৫:৩৩

الر كِتَابٌ أُحْكِمَتْ آَيَاتُهُ ثُمَّ فُصِّلَتْ مِنْ لَدُنْ حَكِيمٍ خَبِيرٍ

আলিফ, লা-ম, রা; এটি এমন এক কিতাব, যার আয়াত সমূহ সুপ্রতিষ্ঠিত অতঃপর সবিস্তারে বর্ণিত এক মহাজ্ঞানী, সর্বজ্ঞ সত্তার পক্ষ হতে। -১১:১

কুরআনে এটাও উচ্চারিত হয়েছে যে, কুরআন হচ্ছে মানবজাতির জন্য চক্ষু-উন্মোচনকারী মহাগ্রন্থ। মানবজাতির জন্য তা আলোকবর্তিকাস্বরূপ (enlightenment and illumination)।

هَذَا بَصَائِرُ لِلنَّاسِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ

এই কুরআন মানবজাতির জন্য চক্ষু-উন্মোচনকারী এবং নিশ্চিত বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য পথনির্দেশ ও রহমত। -৪৫:২০; আরও ৭:২০৩

قَدْ جَاءَكُمْ بَصَائِرُ مِنْ رَبِّكُمْ فَمَنْ أَبْصَرَ فَلِنَفْسِهِ وَمَنْ عَمِيَ فَعَلَيْهَا وَمَا أَنَا عَلَيْكُمْ بِحَفِيظٍ

তোমাদের কাছে তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে নিদর্শনাবলী এসে গেছে। অতএব, যে প্রত্যক্ষ করবে, সে নিজেরই উপকার করবে এবং যে অন্ধ হবে, সে নিজেরই ক্ষতি করবে। আমি তোমাদের পর্যবেক্ষক নই। -৬:১০৪

অনুবাদকগণ বাছায়ির (بَصَائِرُ) পদের অনুবাদে বাংলা ও ইংরেজীতে যে শব্দসমূহ নির্বাচন করেছেন তা হল- সুস্পষ্ট দলীল, নিদর্শনাবলী, সূক্ষ্ন ও দৃষ্টিসম্পন্ন নিদর্শন বা ‘clear proofs’, ‘clear insights’, ‘eye-openers’, ‘enlightening proofs’, ‘means of insight’, ‘enlightenment’, ‘clear perception’, ‘illumination’, ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়েছে।

শাফায়াত সংক্রান্ত অতি জনপ্রিয় ‘হাদীস’

শাফায়াতে কুবরার ‘হাদীসটি’ অতি জনপ্রিয় এবং বলতে গেলে তা প্রায় সকল মুসলিমেরই জানা – কেননা প্রতিনিয়ত তা তাদেরকে শোনানো হয়ে থাকে। বিবৃতিটি এখানে সংক্ষেপে উদ্ধৃত করব এবং পরবর্তীতে তা কুরআনের চোখ দিয়ে দেখবার ও উপলব্ধি করবার চেষ্টা করব।

হাদীসটি একাধিক সূত্র থেকে বর্ণিত হয়েছে যেখান থেকে আমরা জানতে পারি যে, নবীজি বলেছেন, কিয়ামতের দিন আদম সন্তানগণ এত দীর্ঘসময় অপেক্ষারত থাকবে যে, তারা অস্থির, উদ্বিগ্ন এবং ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়বে। তারা তখন পরস্পর বলাবলি করবে যে, চল আমরা কাউকে আমাদের জন্য আমাদের প্রভুর কাছে সুপারিশ করতে অনুরোধ করি যাতে করে তিনি আমাদেরকে এই অবস্থা থেকে মুক্তি দেন।

অতঃপর তারা একে একে হযরত আদম, নূহ, ইবরাহীম, মূসা এবং ঈসা (সালামুন ‘আলাল মুরসালীন) কাছে সাফায়াতের আর্জি নিয়ে হাজির হবে। কিন্তু নবীগণের সকলেই সেই কাজে তাঁদের অপরাগতা প্রকাশ করবেন এক সাধারণ যুক্তিতে যে, আজ আমার প্রভু এতো বেশি ক্রোধান্বিত আছেন যা পূর্বে কখনো হননি, আর পরেও কখনো হবেন না। আল্লাহর কাছে সুপারিশ করতে অসমর্থতার জন্য তাঁরা এর সাথে তাদের যে ‘অপরাধের’ উল্লেখ করবেন তা সংক্ষেপে নীচে দেয়া হল-

আদিপিতা আদমঃ
আল্লাহ আমাকে একটি বৃক্ষের ফল খেতে নিষেধ করেছিলেন, আর আমি সেই নিষেধ লঙ্ঘন করে ফেলেছি, নাফসি! নাফসি! আজ আমি চিন্তায় পেরেশান। তোমরা অন্য কারো কাছে গিয়ে চেষ্টা করে। তোমরা বরং নূহের কাছে যাও।

প্রথম শরিয়তের অধিকারী এবং চির কৃতজ্ঞ বান্দা নূহঃ
আল্লাহ আমাকে একটি দোয়া কবুলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, আর তা আমি আমার জাতির বিরুদ্ধে প্রয়োগ করে ফেলেছি। অতঃপর ‘নাফসি, নাফসি’ বলতে বলতে তিনিও কিয়ামতবাসীকে হযরত ইবরাহীমের কাছে পাঠিয়ে দিবেন। অন্য বর্ণনায় আছে- নিজ সন্তানের ব্যাপারে না জেনেই আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার কারণে আল্লাহ যে তাঁর প্রতি নারাজ হয়েছিলেন- তিনি তার উল্লেখ করবেন।

[দোয়া কবুলের প্রতিশ্রুতি যদি আল্লাহ তাঁকে দিয়ে থাকেন; আর নবী নূহ যদি তা প্রয়োগ করে থাকেন তবে তা কেন তাঁর অপরাধ হতে যাবে?]

আল্লাহর খলীল, ইমাম, জাতির পিতা ও উত্তমাদর্শ ইবরাহীমঃ
মূর্তি ভাঙ্গার বিষয়ে ইবরাহীম তার ‘অসত্য কথনের’ উল্লেখ করে নিজের নফসের পেরেশানিতে অস্থির হয়ে হযরত মূসার কাছে পাঠিয়ে দিবেন। অর্থাৎ কথিত ‘অসত্য বচন বা মিথ্যা কথা’ কিয়ামতে শাফায়াত করার বিষয়ে তাঁর বড় অযোগ্যতা। [আলেম-উলামা সমাজ আমজনতাকে শেখায় হযরত ইবরাহীম ‘মিথ্যা’ বলেছিলেন।]

আল্লাহর সাথে কথোপকথনকারী মহান নবী মূসাঃ
নবী মূসা তাঁর দ্বারা এক ব্যক্তিকে মেরে ফেলার উল্লেখ করে ‘নাফসি-নাফসি’ বলে তার অপারগতা প্রকাশ করবেন এবং মানবজাতিকে হযরত ঈসার কাছে পাঠিয়ে দিবেন।

বহু বহু বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, রুহুল কুদুস দ্বারা সাহায্যপ্রাপ্ত ঈসা ইবনে মারইয়ামঃ
যেমনটি পূর্বের নবীগণ বলেছেন তেমনি তিনিও আল্লাহর ক্রোধের কথা, নিজের পেরেশানীর কথা বলবেন। কিন্তু তিনি তাঁর কোন অপরাধের কথা সুপারিশ করতে না পারার কারণ হিসেবে দেখাবেন না- ‘হাদীসের’ বর্ণনায় তা অনুপস্থিত। বরং কোন কারণ ছাড়াই তাদেরকে তিনি শেষনবী হযরত মুহাম্মদের (তাঁর উপর শান্তি) কাছে পাঠিয়ে দিবেন।

অতঃপর সকলে নবী মুহাম্মদের কাছে গিয়ে হাজির হবে, নবীজি রাজি হয়ে আল্লাহর সমীপে মস্তকাবনত করবেন আর আল্লাহ তাঁকে সুপারিশ করার অনুমতি দিবেন। এভাবেই ‘শাফায়াতে কুবরা’ নামের কিয়ামতের এই পর্ব সমাপ্ত হবে। [সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম]

এখন প্রতিটি মুসলমান মসজিদের মিম্বর এবং ‘ওয়াজের জলসা’ থেকে অহরহ এই বর্ণনা শোনে, আবার অন্যদেরকেও তা শোনায়; কিন্তু কেউ এটা নিয়ে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করতে সাহসী হয় না, যেহেতু তা রাসূলের ভাষ্য হিসেবে তাদেরকে শোনানো হয়।

তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল, কুরআন বিচ্ছিন্নতার কারণে মানুষ এর মধ্যে কোন গলদও খুঁজে পায় না। যদিও তাদের অবচেতন মনে এ জাতীয় বর্ণনা নিয়ে অবোধগম্য অনেক কিছুরই দ্যোতনা হতে থাকে।

অতি সাধারণ কিছু প্রশ্নঃ

উপরিউক্ত কথিত শাফায়াত সংক্রান্ত ‘হাদীসের’ বর্ণনার সবচেয়ে প্রহসনমূলক দিকটি হল, হযরত ঈসা ব্যতীত কোন নবীই ‘সঠিক উত্তর (?)’ দিতে সফল হয় না। সঠিক উত্তর মানে এখানে, যার কাছে গেলে প্রকৃত সমাধান মিলবে বলে ধরে নেয়া হচ্ছে তার নাম বলতে পারা। অথচ এটা ধরে নেয়া হয় যে, পূর্ববর্তী সকল নবীই শেষনবীর কথিত ‘সর্বশ্রেষ্ঠত্বের’ বিষয়টি অবগত ছিলেন।

এটাও বিশ্বাস করা হয়ে থাকে যে, পূর্ববর্তী সকল নবীগণই তাদের নবীত্ব বিসর্জন দিয়ে শেষনবীর কথিত ‘সর্বশ্রেষ্ঠত্বের’ কারণে তাঁর একজন সাধারণ ‘উম্মত’ হওয়ার গৌরব অর্জন করতে চেয়েছিলেন – সেই বিচারে তাদের নিজ নিজে উম্মতগণ এই সত্য সম্পর্কে পূর্ণ অবগত। যদি তাই হয়, তবে কিয়ামতের দিন প্রথম মানব আদম থেকে শুরু করে সকলেরই এটা জানা থাকবার কথা- তাহলে হযরত আদম বা হযরত নূহ সরাসরি শেষনবীর কথা না বলে শুধু তাঁর পরবর্তী নবীর কথা কেন বলবেন? যদি তাঁরা তাদের পরবর্তী নবীর নাম মনে রাখতে পারেন, তবে ‘সর্বশ্রেষ্ঠ’ নবী মুহাম্মাদের নাম কীভাবে ভুলে যাবেন? এটা কি ভুলে ভরা একটা মানব-রচিত প্রহসনের নাটক নয়?

আদিপিতা আদমের ক্ষেত্রে এটাও কথিত আছে যে, তিনি আল্লাহর ক্ষমা পেয়েছিলেন আল্লাহর আরশে দেখতে পাওয়া আল্লাহর নামের সাথে শেষনবীর নামের দোহাই দিয়ে (এটাও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন কথা এবং শুধু মিথ্যাচার নয়, বরং কঠিন শিরকপূর্ণ কথা)। যার নামের দোহাই দিয়ে নিজে মুক্তি পেয়েছেন বলে বর্ণনা আছে সেই আদম কীভাবে কিয়ামতের কঠিন ময়দানে মানুষকে বিভ্রান্ত করে শেষনবীর কথা না বলে তাঁর পরবর্তী নূহ নবীর কথা বলতে পারেন?

আরও পরিহাস হল, শেষনবীর উম্মত দাবীদার যারা, তারা তো তাদের নবীর সর্বশ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে সম্যক অবগত। তারা কিয়ামতের কঠিন দিনে সময় ক্ষেপণ করে সরাসরি শেষনবীর কাছে না গিয়ে কেন পাঁচ-পাঁচজন নবীর কাছে গিয়ে বৃথা সময় নষ্ট করবে? তাদের তো কর্তব্য পূর্ববর্তী সকল নবীর উম্মতগণকে নেতৃত্ব দিয়ে সরাসরি শেষনবীর কাছে পৌঁছানো। তারা আদিপিতা আদমকে স্মরণ করতে বা মনে রাখতে পারবে, আর তাঁদের দাবীকৃত ‘সর্বশ্রেষ্ঠ’ নবী মুহাম্মদকে মনে রাখতে পারবে না? বাংলায় যাকে আমরা আঁষাঢ়ে গল্প বলি- এটা যেন ঠিক তাই।

আরও বলা হয়ে থাকে যে, মৃত্যুর পর কবরে কতিপয় প্রশ্ন করা হবে, যার একটি – মান নাবিয়্যুকা (তোমার নবী কে?)। ঈমানদারগণ এই প্রশ্নের সঠিক উত্তরে শেষনবীর নাম বলে দেবে। অথচ কী আশ্চর্য যে, এরাই সেই মহান নবীর নাম ভুলে গিয়ে কিয়ামতের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত চষে বেড়াবে ‘মুক্তিদাতার’ অন্বেষায়!

এখন আমরা একটু পেছনে ফিরে তাকাতে চেষ্টা করব, কিয়ামতের ময়দানের কথিত প্রেক্ষাপটে নবীগণ যে সকল কারণ দেখিয়ে তাদের অসহায়ত্বের কথা প্রকাশ করবেন তার ভিত্তি কী? সুপারিশ করতে অসমর্থতার জন্য যে সব কারণ তাদের মুখ দ্বারা আলোচ্য ‘হাদীসে’ বলানো হয়েছে, যদি তা যথার্থ হয় তবে এটা নিশ্চিত যে, শেষনবী নিজেও নিদেনপক্ষে নিম্নোক্ত ৭ টি কারণে আমাদের জন্য সেদিন সুপারিশের লক্ষ্যে উদ্যোগী হতে সাহসী হবেন না।

১. শেষনবী কর্তৃক ‘অভিশাপ’ দেবার ঘটনা

অহুদের যুদ্ধে নবী মুহাম্মদ (তাঁর উপর শান্তি) অত্যন্ত সঙ্গীন এবং প্রতিকুল পরিস্থিতিতে কতিপয় অবিশ্বাসী কাফিরের নাম উল্লেখপূর্বক অভিশাপ বা লা’নত প্রদান করেন। বিষয়টি আল্লাহ একেবারেই সমর্থন করেন নি এবং নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল করে সতর্ক করে দেন যে, এ কাজের কোন কর্তৃত্ব তাঁর নেই।

لَيْسَ لَكَ مِنَ الْأَمْرِ شَيْءٌ أَوْ يَتُوبَ عَلَيْهِمْ أَوْ يُعَذِّبَهُمْ فَإِنَّهُمْ ظَالِمُونَ

হয় আল্লাহ তাদের ক্ষমা করবেন কিংবা তাদেরকে আযাব দেবেন। এ ব্যাপারে তোমার কোন এখতিয়ার নাই। কারণ তারা রয়েছে অন্যায়ের উপর। -৩:১২৮

২. দরিদ্র এবং দাসশ্রেণীর মু’মিনদের মসজিদ থেকে বিতাড়ন

একদা কিছু কুরাইশ আরব সর্দার নবীজির সাক্ষাতপ্রার্থী হয় যখন তিনি মসজিদে মু’মিনদের সাথে আলাপরত ছিলেন যাদের অধিকাংশই ছিলেন হতঃদরিদ্র এবং দাসশ্রেণীর – যারা ‘আছহাবে ছুফ্ফা’ নামে পরিচিত। কুরাইশ সর্দারগণ রাসূলের সাথে তাদের দৃষ্টিতে নিম্নজাতের এই মানুষগুলোকে দেখে তাদের পাশে বসে রাসূলের সাথে কথা বলতে আপত্তি জানায় এবং তাদেরকে প্রথমে বের করে দেবার শর্ত প্রয়োগ করে; কেননা কেউ কেউ পূর্বে তাদের দাস ছিলেন। রাসূল এতে সম্মতি না দিলে ছাহাবী ওমরের পরামর্শে শেষপর্যন্ত রাসূল তাদেরকে ঐ সময়ের জন্য বাইরে যেতে বলেন। আর সেই সব মু’মিন ছাহাবীগণ আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের এতই অনুগত ছিলেন যে, রাসূলের সকল নির্দেশ মেনে নেবার জন্য তাঁরা সদা প্রস্তুত ছিলেন।

কিন্তু এই আচরণটি আল্লাহর একেবারেই পছন্দ হয় নি; শুধু তাই নয় তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছেন- তার সুস্পষ্ট প্রকাশ আমরা নাযিলকৃত আয়াতেই দেখতে পাব।

وَلَا تَطْرُدِ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ مَا عَلَيْكَ مِنْ حِسَابِهِمْ مِنْ شَيْءٍ وَمَا مِنْ حِسَابِكَ عَلَيْهِمْ مِنْ شَيْءٍ فَتَطْرُدَهُمْ فَتَكُونَ مِنَ الظَّالِمِينَ

আর তাদেরকে বিতাড়িত করবে না, যারা সকাল-বিকাল স্বীয় পালকর্তার এবাদত করে, তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে। তাদের হিসাব বিন্দুমাত্রও তোমার দায়িত্বে নয় এবং তোমার হিসাব বিন্দুমাত্রও তাদের দায়িত্বে নয় যে, তুমি তাদেরকে বিতাড়িত করবে। নতুবা তুমি জালিমদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাবে। -৬:৫২

এ হেন ঘটনা পূর্ববর্তী নবীদের আমলেও ঘটেছে, তার দৃষ্টান্ত কুরআনে পাওয়া যায়। প্রায় সমজাতীয় ঘটনার প্রেক্ষাপটে সালামুন ‘আলা নূহ দরিদ্র শ্রেণীর মু’মিনদিগকে বের না করে দিয়ে বলেন-

إِنْ حِسَابُهُمْ إِلَّا عَلَى رَبِّي لَوْ تَشْعُرُونَ * وَمَا أَنَا بِطَارِدِ الْمُؤْمِنِينَ

আমি মুমিনগণকে তাড়িয়ে দেয়ার লোক নই। -২৬:১১৪

وَمَا أَنَا بِطَارِدِ الَّذِينَ آَمَنُوا إِنَّهُمْ مُلَاقُو رَبِّهِمْ وَلَكِنِّي أَرَاكُمْ قَوْمًا تَجْهَلُونَ * وَيَا قَوْمِ مَنْ يَنْصُرُنِي مِنَ اللَّهِ إِنْ طَرَدْتُهُمْ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ

আমি কিন্তু ঈমানদারদের তাড়িয়ে দিতে পারি না। তারা অবশ্যই তাদের পালনকর্তার সাক্ষাত লাভ করবে। বরঞ্চ তোমাদেরই আমি অজ্ঞ সম্প্রদায় দেখছি। আর হে আমার জাতি! আমি যদি তাদের তাড়িয়ে দেই তাহলে আমাকে আল্লাহ হতে রেহাই দেবে কে? তোমরা কি চিন্তা করে দেখ না? -১১:২৯-৩০

৩. একজন অন্ধ মু’মিন ছাহাবী থেকে ভ্রুকুঞ্চন করে মুখ ফিরিয়ে নেয়া

কোন এক কুরআনী জলসায় রাসূল অনেকের উদ্দেশ্যে বক্তব্য পেশ করছিলেন- যেখানে মু’মিন-মুসলিমদের সাথে কাফের নেতৃবৃন্দও ছিল। এমন অবস্থায় সেখানে এক অন্ধ মু’মিন ছাহাবী এসে হাজির হন এবং রাসূলের কাছে দীনের কোন বিষয় জানতে প্রশ্ন করেন। সেই ছাহাবীর প্রশ্নের চেয়ে কাফের সর্দারদের সাথে আলাপচারিতা রাসূলের কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়েছিল। কিন্তু আল্লাহর মানদন্ডে মু’মিনের দাবী অগ্রাধিকার পাবার যোগ্য। এ জন্য আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীকে অনেক কথা শুনিয়ে নীচের আয়াতগুলো নাযিল করেন।

عَبَسَ وَتَوَلَّى * أَنْ جَاءَهُ الْأَعْمَى * وَمَا يُدْرِيكَ لَعَلَّهُ يَزَّكَّى * أَوْ يَذَّكَّرُ فَتَنْفَعَهُ الذِّكْرَى * أَمَّا مَنِ اسْتَغْنَى * فَأَنْتَ لَهُ تَصَدَّى * وَمَا عَلَيْكَ أَلَّا يَزَّكَّى * وَأَمَّا مَنْ جَاءَكَ يَسْعَى * وَهُوَ يَخْشَى * فَأَنْتَ عَنْهُ تَلَهَّى * كَلَّا إِنَّهَا تَذْكِرَةٌ * فَمَنْ شَاءَ ذَكَرَهُ

সে ভ্রূকুঞ্চিত করল এবং মুখ ফিরিয়ে নিল। কারণ, তাঁর কাছে এক অন্ধ আগমন করল। তুমি কি জান, সে হয়তো পরিশুদ্ধ হত, অথবা উপদেশ গ্রহণ করতো এবং উপদেশ তার উপকার হত। পরন্তু যে বেপরোয়া, তুমি তার চিন্তায় মশগুল। সে শুদ্ধ না হলে তোমার কোন দোষ নেই। যে তোমার কাছে দৌড়ে আসলো এমতাবস্থায় যে, সে ভয় করে, তুমি তাকে অবজ্ঞা করল। কখনও এরূপ করবে না, এটা উপদেশবানী। অতএব, যে ইচ্ছা করবে, সে একে গ্রহণ করবে। -৮০:১-১২

৪. মধু পান না করার প্রতিজ্ঞা

কোন এক ঘটনার প্রেক্ষাপটে নবীজি হালাল মধুকে নিজের জন্য হারাম ঘোষণা করেছিলেন; যদিও তা আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ বা হারাম ঘোষিত হয় নি। কাজেই আল্লাহ তাঁর রাসূলের এই নিষিদ্ধকরণের কাজকে অনুমোদন দেন নি। বরঞ্চ তাঁকে হুশিয়ার করেছেন।

يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ لِمَ تُحَرِّمُ مَا أَحَلَّ اللَّهُ لَكَ تَبْتَغِي مَرْضَاةَ أَزْوَاجِكَ

হে নবী, আল্লাহ তোমার জন্যে যা হালাল করছেন, তুমি তোমার স্ত্রীদেরকে খুশী করার জন্যে তা নিজের জন্যে হারাম করছো কেন? আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়াময়। -৬৬:১

বহু বর্ণিল মধু আল্লাহ প্রদত্ত একটি খুবই উপকারী প্রাকৃতিক পানীয় যার মধ্যে মানবজাতির বহু রোগমুক্তি রয়েছে বলে কুরআনে ঘোষণা আছে।

ثُمَّ كُلِي مِنْ كُلِّ الثَّمَرَاتِ فَاسْلُكِي سُبُلَ رَبِّكِ ذُلُلًا يَخْرُجُ مِنْ بُطُونِهَا شَرَابٌ مُخْتَلِفٌ أَلْوَانُهُ فِيهِ شِفَاءٌ لِلنَّاسِ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَةً لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ

(মৌমাছির উদ্দেশ্যে আল্লাহ বলেন) এরপর সর্বপ্রকার ফল থেকে ভক্ষণ কর এবং আপন পালনকর্তার উম্মুক্ত পথ সমূহে চলমান হও। তার পেট থেকে বিভিন্ন রঙের পানীয় নির্গত হয়। তাতে মানুষের জন্যে রয়েছে রোগের প্রতিকার। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্যে নিদর্শন রয়েছে। -১৬:৬৯

মধুর বহুমাত্রিক বাস্তব ব্যবহার রয়েছে। মধু আহরণকারী মৌমাছি নিয়ে মহিমান্বিত কুরআনে একটি সূরাই আছে- সূরা আন-নাহল (১৬)।

যদি নবী কর্তৃক মধু নিষিদ্ধ হবার পর আল্লাহ তা সংশোধন করে না দিতেন, তাহলে মুসলিম উম্মাহর জন্যও মধু নিষিদ্ধই থাকত। যে খাদ্য কোন কারণে রাসূল নিজে ভক্ষণ করেন নাই, তা গ্রহণ করা আল্লাহ-রাসূলের অবাধ্যতা বা বিরুদ্ধাচরণরূপেই গণ্য হত। উম্মাহর কোটি কোটি সদস্য প্রাকৃতিক এই সূধা- মধুর বহুমুখী উপকারিতা লাভ থেকে বঞ্চিত হত। আবার বহু মুসলিম এই উপকারিত বা এর স্বাদ গ্রহণের জন্য ‘মধু নিষিদ্ধ’-এর নিয়মও গোপনে বা প্রকাশ্যে লংঘন করত।

৫. নবী কর্তৃক একজন নিরপরাধ ইহুদীকে দোষী সাব্যস্ত করা ও রায় প্রদান করা।

নবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ ভুলক্রমে একজন মুসলমানের অপরাধের দায় একজন ইহুদীকে দিয়ে তাকে শাস্তির রায় প্রদান করেছিলেন বা প্রদানে উদ্যত হয়েছিলেন। আর সেই কাজে তাঁকে মিথ্যা সাক্ষ্য-প্রমান দিয়ে প্ররোচিত করেছিল মূল অপরাধির কতিপয় সহযোগী মুসলিম। এটা এত বড় একটি গর্হিত এবং অন্যায় রায় ছিল যে, আল্লাহ তা মোটেই সহ্য করতে পারেন নি এবং আরশ থেকে রায় প্রদান করে নিরপরাধ ইহুদীকে মুক্ত করেন এবং নবীকে সংশোধন করেন। একজন নিষ্পাপ মানুষকে আর একজনের অপরাধের কারণে স্বয়ং নবী কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত করা কাউকে হত্যা করে ফেলার চেয়ে কম কিছু নয় যা আল্লাহ দীর্ঘস্থায়ী হতে দেন নি।

إِنَّا أَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِتَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ بِمَا أَرَاكَ اللَّهُ وَلَا تَكُنْ لِلْخَائِنِينَ خَصِيمًا * وَاسْتَغْفِرِ اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ غَفُورًا رَحِيمًا * وَلَا تُجَادِلْ عَنِ الَّذِينَ يَخْتَانُونَ أَنْفُسَهُمْ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ مَنْ كَانَ خَوَّانًا أَثِيمًا * يَسْتَخْفُونَ مِنَ النَّاسِ وَلَا يَسْتَخْفُونَ مِنَ اللَّهِ وَهُوَ مَعَهُمْ إِذْ يُبَيِّتُونَ مَا لَا يَرْضَى مِنَ الْقَوْلِ وَكَانَ اللَّهُ بِمَا يَعْمَلُونَ مُحِيطًا * هَا أَنْتُمْ هَؤُلَاءِ جَادَلْتُمْ عَنْهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا فَمَنْ يُجَادِلُ اللَّهَ عَنْهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَمْ مَنْ يَكُونُ عَلَيْهِمْ وَكِيلًا * وَمَنْ يَعْمَلْ سُوءًا أَوْ يَظْلِمْ نَفْسَهُ ثُمَّ يَسْتَغْفِرِ اللَّهَ يَجِدِ اللَّهَ غَفُورًا رَحِيمًا * وَمَنْ يَكْسِبْ إِثْمًا فَإِنَّمَا يَكْسِبُهُ عَلَى نَفْسِهِ وَكَانَ اللَّهُ عَلِيمًا حَكِيمًا * وَمَنْ يَكْسِبْ خَطِيئَةً أَوْ إِثْمًا ثُمَّ يَرْمِ بِهِ بَرِيئًا فَقَدِ احْتَمَلَ بُهْتَانًا وَإِثْمًا مُبِينًا * وَلَوْلَا فَضْلُ اللَّهِ عَلَيْكَ وَرَحْمَتُهُ لَهَمَّتْ طَائِفَةٌ مِنْهُمْ أَنْ يُضِلُّوكَ وَمَا يُضِلُّونَ إِلَّا أَنْفُسَهُمْ وَمَا يَضُرُّونَكَ مِنْ شَيْءٍ وَأَنْزَلَ اللَّهُ عَلَيْكَ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَعَلَّمَكَ مَا لَمْ تَكُنْ تَعْلَمُ وَكَانَ فَضْلُ اللَّهِ عَلَيْكَ عَظِيمًا

নিশ্চয় আমি তোমার প্রতি সত্য কিতাব অবতীর্ণ করেছি, যাতে তুমি মানুষের মধ্যে ফয়সালা কর, যা আল্লাহ তোমাকে হৃদয়ঙ্গম করান। তুমি বিশ্বাসঘাতকদের পক্ষ থেকে বিতর্ককারী হয়ো না। এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু। যারা মনে বিশ্বাসঘাতকতা পোষণ করে তাদের পক্ষ থেকে বিতর্ক করবে না। আল্লাহ পছন্দ করেন না তাকে, যে বিশ্বাসঘাতক পাপী হয়। তারা মানুষের কাছে লজ্জিত হয় এবং আল্লাহর কাছে লজ্জিত হয় না। তিনি তাদের সাথে রয়েছেন, যখন তারা রাত্রে এমন বিষয়ে পরামর্শ করে, যাতে আল্লাহ সম্মত নন। তারা যা কিছু করে, সবই আল্লাহর আয়ত্তাধীণ। শুনছ? তোমরা তাদের পক্ষ থেকে পার্থিব জীবনে বিবাদ করছ, অতঃপর কেয়ামতের দিনে তাদের পক্ষ হয়ে আল্লাহর সাথে কে বিবাদ করবে অথবা কে তাদের কার্যনির্বাহী হবে। যে গোনাহ, করে কিংবা নিজের অনিষ্ট করে, অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, সে আল্লাহকে ক্ষমাশীল, করুণাময় পায়। যে কেউ পাপ করে, সে নিজের পক্ষেই করে। আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়। যে ব্যক্তি ভূল কিংবা গোনাহ করে, অতঃপর কোন নিরপরাধের উপর অপবাদ আরোপ করে সে নিজের মাথায় বহন করে জঘন্য মিথ্যা ও প্রকাশ্য গোনাহ। যদি তোমার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণা না হত, তবে তাদের একদল তোমাকে পথভ্রষ্ট করার সংকল্প করেই ফেলেছিল। তারা পথভ্রান্ত করতে পারে না কিন্তু নিজেদেরকেই এবং তোমার কোন অনিষ্ট করতে পারে না। আল্লাহ তোমার প্রতি ঐশীগ্রন্থ ও প্রজ্ঞা অবতীর্ণ করেছেন এবং তোমাকে এমন বিষয় শিক্ষা দিয়েছেন, যা তুমি জানতে না। তোমার প্রতি আল্লাহর করুণা অসীম। -৪:১০৫-১১৩

৬. দ্বিগুন শাস্তির হুমকি

কুরআনে দু’টি প্রেক্ষাপটে নবী মুহাম্মদকে (তাঁর উপর শান্তি) সতর্ক করা হয়েছে যে, যদি আল্লাহ তাঁকে মজবুত ও দৃঢ়পদ না রাখতেন, তবে কিছু মানুষ তাকে বিপথগামী করেই ছাড়ত।

وَإِنْ كَادُوا لَيَفْتِنُونَكَ عَنِ الَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ لِتَفْتَرِيَ عَلَيْنَا غَيْرَهُ وَإِذًا لَاتَّخَذُوكَ خَلِيلًا * وَلَوْلَا أَنْ ثَبَّتْنَاكَ لَقَدْ كِدْتَ تَرْكَنُ إِلَيْهِمْ شَيْئًا قَلِيلًا * إِذًا لَأَذَقْنَاكَ ضِعْفَ الْحَيَاةِ وَضِعْفَ الْمَمَاتِ ثُمَّ لَا تَجِدُ لَكَ عَلَيْنَا نَصِيرًا

তারা তো তোমাকে হটিয়ে দিতে চাচ্ছিল যে বিষয় আমি তোমার প্রতি ওহীর মাধ্যমে যা প্রেরণ করেছি তা থেকে তোমার পদঙ্খলন ঘটানোর জন্যে তারা চুড়ান্ত চেষ্টা করেছে, যাতে তুমি আমার প্রতি কিছু মিথ্যা সম্বন্ধযুক্ত করো। এতে সফল হলে তারা তোমাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে নিত। আমি তোমাকে দৃঢ়পদ না রাখলে তুমি তাদের প্রতি কিছুটা ঝুঁকেই পড়তে। তখন আমি অবশ্যই তোমাকে ইহজীবনে ও পরজীবনে দ্বিগুণ শাস্তির আস্বাদন করাতাম। এ সময় তুমি আমার মোকাবিলায় কোন সাহায্যকারী পেতে না। -১৭:৭৩-৭৫

এখানে দ্ব্যর্থহীনভাবে আল্লাহ তাঁর শেষনবীকে দ্বিগুণ শাস্তির হুমকি শুনিয়ে দিচ্ছেন যদি রাসূল ষড়যন্ত্রকারীদের ছলনায় ঝুঁকে পড়তেন- আল্লাহই তাঁকে বিশেষ অনুগ্রহে রক্ষা করেছেন সেই কঠিন শাস্তি থেকে।

দ্বিগুণ শাস্তির সম্ভাবনা এবং সে সংক্রান্ত হুমকি থেকে আল্লাহ শেষনবীর স্ত্রীগণকেও রেহাই দেননি।

يَا نِسَاءَ النَّبِيِّ مَنْ يَأْتِ مِنْكُنَّ بِفَاحِشَةٍ مُبَيِّنَةٍ يُضَاعَفْ لَهَا الْعَذَابُ ضِعْفَيْنِ وَكَانَ ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرًا

হে নবী পত্নীগণ! তোমাদের মধ্যে কেউ প্রকাশ্য অশ্লীল কাজ করলে তাকে দ্বিগুণ শাস্তি দেয়া হবে। এটা আল্লাহর জন্য সহজ। -৩৩:৩০

إِنْ تَتُوبَا إِلَى اللَّهِ فَقَدْ صَغَتْ قُلُوبُكُمَا وَإِنْ تَظَاهَرَا عَلَيْهِ فَإِنَّ اللَّهَ هُوَ مَوْلَاهُ وَجِبْرِيلُ وَصَالِحُ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمَلَائِكَةُ بَعْدَ ذَلِكَ ظَهِيرٌ

তোমাদের অন্তর অন্যায়ের দিকে ঝুঁকে পড়েছে বলে যদি তোমরা উভয়ে তওবা কর, তবে ভালকথা। আর যদি নবীর বিরুদ্ধে একে অপরকে সাহায্য কর, তবে জেনে রেখ আল্লাহ জিবরাঈল এবং সৎকর্মপরায়ণ মুমিনগণ তাঁর সহায়। উপরন্তু ফেরেশতাগণও তাঁর সাহায্যকারী। -৬৬:৪

৭. তুমি তোমার পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো

কোন মু’মিন-মুসলিমই একথা বলতে পারে না যে, এ জাতীয় আয়াতের আলোচনার মাধ্যমে শেষনবীকে হেয় বা ছোট করার অপপ্রয়াস চালানো হচ্ছে। যদি তাই হত, তবে আল্লাহ নিজেই সেই আলোচনা কুরআনে করতেন না। এগুলো কোন গোপন আয়াতসমষ্টি নয়; বরং তা পুরো মানবজাতির জন্য বিস্তৃত পাঠ, পরীক্ষা-নিরিক্ষা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে।

বেশ কিছু আয়াতে আল্লাহ শেষনবীকে তাঁর পাপের কারণে ক্ষমা চাইতে নির্দেশ দিয়েছেন।

فَاصْبِرْ إِنَّ وَعْدَ اللَّهِ حَقٌّ وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ

অতএব, তুমি সবর করো নিশ্চয় আল্লাহর ওয়াদা সত্য। তুমি তোমার গোনাহের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করো। -৪০:৫৫

فَاعْلَمْ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ

জেনে রাখ, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। ক্ষমা প্রার্থনা করো, তোমার পাপের জন্যে। -৪৭:১৯

لِيَغْفِرَ لَكَ اللَّهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ

যাতে আল্লাহ তোমার অতীত ও ভবিষ্যত পাপসমূহ মার্জনা করে দেন। -৪৮:১-২

তুমি বিশ্বাসঘাতকদের পক্ষ থেকে বিতর্ককারী হয়ো না। এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। -৪:১০৫-১০৬

কুরআনে তিনবার ‘জামবিকা’ ব্যবহৃত হয়েছে যার অর্থ ‘তোমার পাপ বা গুনাহ’। এর বাইরে বহু বহু বার নবীকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তদুপরি, সূরা হাক্কায় আল্লাহ তা’য়ালা ‘যদি’-যোগে (وَلَوْ) বলেন, যদি নবী কর্তৃক এই কুরআনে কোন কিছু তিনি আল্লাহর নামে মনগড়া আরোপ করতেন তবে তাঁর জন্য নেমে আসত ভয়াবহ পরিণতি।

إِنَّهُ لَقَوْلُ رَسُولٍ كَرِيمٍ * وَمَا هُوَ بِقَوْلِ شَاعِرٍ قَلِيلًا مَا تُؤْمِنُونَ * وَلَا بِقَوْلِ كَاهِنٍ قَلِيلًا مَا تَذَكَّرُونَ * تَنْزِيلٌ مِنْ رَبِّ الْعَالَمِينَ * وَلَوْ تَقَوَّلَ عَلَيْنَا بَعْضَ الْأَقَاوِيلِ * لَأَخَذْنَا مِنْهُ بِالْيَمِينِ * ثُمَّ لَقَطَعْنَا مِنْهُ الْوَتِينَ * فَمَا مِنْكُمْ مِنْ أَحَدٍ عَنْهُ حَاجِزِينَ

নিশ্চয়ই এই কোরআন একজন সম্মানিত রাসূলের আনীত। এবং এটা কোন কবির কালাম নয়; তোমরা কমই বিশ্বাস কর। এবং এটা কোন অতীন্দ্রিয়বাদীর কথা নয়; তোমরা কমই অনুধাবন কর। এটা বিশ্বপালনকর্তার কাছ থেকে অবতীর্ণ। সে যদি আমার নামে কোন কথা রচনা করত, তবে আমি তার দক্ষিণ হস্ত ধরে ফেলতাম, অতঃপর কেটে দিতাম তার গ্রীবা। তোমাদের কেউ তাকে রক্ষা করতে পারতে না।– ৬৯:৪০-৪৭

যদিও সূরা আত-তুরে আল্লাহ সত্যায়ন করেন যে, নবীজি নিজে থেকে এই কুরআন রচনা করেন নাই।

أَمْ يَقُولُونَ تَقَوَّلَهُ بَلْ لَا يُؤْمِنُونَ

না তারা বলেঃ এই কোরআন সে নিজে রচনা করেছে? বরং তারা অবিশ্বাসী। -৫২:৩৩

এখন যেসব কারণ উল্লেখ করে হযরত আদম, নূহ, ইবরাহীম, মূসা কিয়ামতের দিবসে সুপারিশ করতে তাদের অপারগতা প্রকাশ করবেন আল্লাহর ভয়ে, শেষনবীর ক্ষেত্রে আলোচিত সাতটি কারণ তারচেয়ে কি অনেক গুরুতর নয়? পূর্ববর্তী নবীগণ যদি কথিত সেই একটি ‘অপরাধের’ কারণে সাফায়াত করার সাহস না দেখান, তাহলে শেষনবী কীভাবে এত এত ‘অপরাধসমূহ (?)’ নিয়ে সেই সাহস প্রদর্শন করবেন?

মহান নবীগনের বিরুদ্ধে কল্পনাপ্রসূত অভিযোগ খন্ডন

এবার যাচাই করা যাক, উপরিউক্ত হাদীসে মহান নবীগণের বিরুদ্ধে যে কল্পিত অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে, সে ব্যাপারে কুরআন কী বলে।

হযরত আদম

যখন হযরত আদম (তাঁর উপর শান্তি) পৃথিবীতে পদার্পন করেন, তখন তিনি তাঁর কৃত ভুলের জন্য অনুতাপ-অনুশোচনা করেন; এবং আল্লাহ তাঁর ওয়াদা মাফিক তাঁর প্রতি তাঁর অনুগ্রহ বর্ষণ করেন। আল্লাহ তাঁকে নির্বাচিত করেন এবং সঠিক হেদায়েতের পথ প্রদর্শন করেন।

ثُمَّ اجْتَبَاهُ رَبُّهُ فَتَابَ عَلَيْهِ وَهَدَى

এরপর তার পালনকর্তা তাকে মনোনীত করলেন, তার প্রতি মনোযোগী হলেন এবং তাকে সুপথে আনয়ন করলেন। -২০:১২২

فَتَلَقَّى آَدَمُ مِنْ رَبِّهِ كَلِمَاتٍ فَتَابَ عَلَيْهِ إِنَّهُ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ

অতঃপর হযরত আদম (আঃ) স্বীয় পালনকর্তার কাছ থেকে কয়েকটি কথা শিখে নিলেন, অতঃপর আল্লাহ পাক তাঁর প্রতি (করুণাভরে) লক্ষ্য করলেন। নিশ্চয়ই তিনি মহা-ক্ষমাশীলও অসীম দয়ালু। -২:৩৭

এটা সম্পূর্ণ পরিষ্কার যে, হযরত আদম আল্লাহ কর্তৃক পৃথিবীতেই ক্ষমাকৃত এবং হেদায়েতপ্রাপ্ত ছিলেন- কুরআন তা একাধিক বিবৃতির মধ্য দিয়ে সত্যায়ন করে। সুতরাং, শেষনবীর নামে বাড়াবাড়ি আরোপ করতে গিয়ে আমরা প্রকারান্তরে মানবজাতির আদিপিতা হযরত আদমকে হেয় ও ছোট করে উপস্থাপন করবার ধৃষ্টতা দেখাচ্ছি – যা মোটেই সত্য নয়।

তারচেয়েও বড় কথা, মানব সৃষ্টির একেবারে প্রারম্ভে জান্নাতে ঘটিত আদমের ভুলের সাথে, পৃথিবীতে সংঘটিত নবীগণের কৃত ভুলকে এক পাল্লায় মাপা যায় না। পৃথিবীতে আগমনের পর আমাদের সবার আদিপিতার আর কোন ভুল বা পাপের উল্লেখ আমরা পুরো কুরআনে পাই না।

হযরত নূহ

একজন পিতা এবং নবী হিসেবে হযরত নূহ আল্লাহর কাছে নিজ সন্তানের জন্য ক্ষমা চান। সেজন্যে আল্লাহ তাঁকে সতর্ক করেন এই বলে যে, তাঁর সন্তান তাঁর পরিবারভুক্ত নয়, বরং একজন অসৎ মানুষ; এবং তাঁর উচিত নয় তার জন্য প্রার্থনা করা। হযরত নূহ তাৎক্ষণিকভাবে আল্লাহর কাছে নিজ অজ্ঞতার জন্য ক্ষমা ভিক্ষা চান এবং সেই বিষয় থেকে পানাহ চান যে বিষয়ে তাঁর জ্ঞান নেই। আল্লাহ নিজ নবীর প্রতি সদয় হন এবং তাঁর প্রতি তাঁর ‘শান্তি এবং কল্যান’ (বিসালামিম মিন্না ওয়া বারাকাত) বর্ষনের ঘোষণা জানিয়ে দেন।

وَنَادَى نُوحٌ رَبَّهُ فَقَالَ رَبِّ إِنَّ ابْنِي مِنْ أَهْلِي وَإِنَّ وَعْدَكَ الْحَقُّ وَأَنْتَ أَحْكَمُ الْحَاكِمِينَ * قَالَ يَا نُوحُ إِنَّهُ لَيْسَ مِنْ أَهْلِكَ إِنَّهُ عَمَلٌ غَيْرُ صَالِحٍ فَلَا تَسْأَلْنِ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنِّي أَعِظُكَ أَنْ تَكُونَ مِنَ الْجَاهِلِينَ * قَالَ رَبِّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ أَنْ أَسْأَلَكَ مَا لَيْسَ لِي بِهِ عِلْمٌ وَإِلَّا تَغْفِرْ لِي وَتَرْحَمْنِي أَكُنْ مِنَ الْخَاسِرِينَ * قِيلَ يَا نُوحُ اهْبِطْ بِسَلَامٍ مِنَّا وَبَرَكَاتٍ عَلَيْكَ وَعَلَى أُمَمٍ مِمَّنْ مَعَكَ

আর নূহ (আঃ) তাঁর পালনকর্তাকে ডেকে বললেন- হে পরওয়ারদেগার, আমার পুত্র তো আমার পরিজনদের অন্তর্ভুক্ত; আর আপনার ওয়াদাও নিঃসন্দেহে সত্য আর আপনিই সর্বাপেক্ষা বিজ্ঞ ফয়সালাকারী। আল্লাহ বলেন, হে নূহ! নিশ্চয় সে তোমার পরিবারভুক্ত নয়। নিশ্চই সে দুরাচার! সুতরাং আমার কাছে এমন দরখাস্ত করবে না, যার খবর তুমি জানো না। আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি যে, তুমি অজ্ঞদের দলভুক্ত হয়ো না। নূহ (আঃ) বলেন- হে আমার পালনকর্তা আমার যা জানা নেই এমন কোন দরখাস্ত করা হতে আমি আপনার কাছেই আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আপনি যদি আমাকে ক্ষমা না করেন, দয়া না করেন, তাহলে আমি ক্ষতিগ্রস্ত হব। বলা হল- হে নূহ! অবতরণ কর আমাদের থেকে শান্তির সাথে, আর তোমার উপরে ও তোমার সাথে যারা রয়েছে তাদের সম্প্রদায়ের উপরে আশীর্বাদ নিয়ে। -১১:৪৫-৪৮

হযরত নূহ সম্পর্কে আল্লাহ আরও যা কিছু অতিরিক্ত বলেছেন, তা হল তিনি ছিলেন মুখলিছিন (الْمُخْلَصِينَ)

وَلَقَدْ نَادَانَا نُوحٌ فَلَنِعْمَ الْمُجِيبُونَ * وَنَجَّيْنَاهُ وَأَهْلَهُ مِنَ الْكَرْبِ الْعَظِيمِ * وَجَعَلْنَا ذُرِّيَّتَهُ هُمُ الْبَاقِينَ * وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الْآَخِرِينَ * سَلَامٌ عَلَى نُوحٍ فِي الْعَالَمِينَ * إِنَّا كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ * إِنَّهُ مِنْ عِبَادِنَا الْمُؤْمِنِينَ

আর নূহ আমাকে ডেকেছিল। আর কি চমৎকারভাবে আমি তার ডাকে সাড়া দিয়েছিলাম। আমি তাকে ও তার পরিবারবর্গকে এক মহাসংকট থেকে রক্ষা করেছিলাম। এবং তার বংশধরদেরকেই আমি অবশিষ্ট রেখেছিলাম। আমি তার জন্যে পরবর্তীদের মধ্যে এ বিষয় রেখে দিয়েছি যে, বিশ্ববাসীর মধ্যে নূহের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। আমি এভাবেই সৎকর্ম পরায়নদেরকে পুরস্কৃত করে থাকি। সে ছিল আমার ঈমানদার বান্দাদের অন্যতম। -৩৭:৭৫-৮১

وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا نُوحًا وَإِبْرَاهِيمَ وَجَعَلْنَا فِي ذُرِّيَّتِهِمَا النُّبُوَّةَ وَالْكِتَابَ

আমি নূহ ও ইব্রাহীমকে রসূলরূপে প্রেরণ করেছি এবং তাদের বংশধরের মধ্যে নবুওয়ত ও কিতাব অব্যাহত রেখেছি। অতঃপর তাদের কতক সৎপথপ্রাপ্ত হয়েছে এবং অধিকাংশই হয়েছে পাপাচারী। -৫৭:২৬

سَلَامٌ عَلَى نُوحٍ فِي الْعَالَمِينَ

বিশ্ববাসীর মধ্যে নূহের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। -৩৭:৭৯

হযরত ইবরাহীম

হযরত ইবরাহীম কুরআনুল কারীমে চিত্রিত নবীগণের মধ্যে সবচেয়ে অধিক সম্মানিত, অনুসরণীয় এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় নবী। যাকে আল্লাহ ‘সিদ্দীকান নাবিয়্যা’ বা অতি সত্যবাদী নবী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّهُ كَانَ صِدِّيقًا نَبِيًّا

(হে মুহাম্মদ) তুমি এই কিতাবে ইব্রাহীমের কথা বর্ণনা করো। নিশ্চয় তিনি ছিলেন সত্যবাদী, নবী। -১৯:৪১

আমাদের মত হতভাগা আর কে হতে পারে, আল্লাহ নিজে যার নবীকে সত্যবাদী নবী হিসেবে আমাদের সামনে উপস্থাপিত করলেন, আমরা আমাদের হঠকারিতা আর দূর্বৃত্তপনা দ্বারা তাঁকেই হাজির করলাম ‘মিথ্যাবাদী’ হিসেবে।

أُولَئِكَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ مِنْ ذُرِّيَّةِ آَدَمَ وَمِمَّنْ حَمَلْنَا مَعَ نُوحٍ وَمِنْ ذُرِّيَّةِ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْرَائِيلَ وَمِمَّنْ هَدَيْنَا وَاجْتَبَيْنَا إِذَا تُتْلَى عَلَيْهِمْ آَيَاتُ الرَّحْمَنِ خَرُّوا سُجَّدًا وَبُكِيًّا

এরাই তারা- নবীগণের মধ্য থেকে যাদেরকে আল্লাহ তা’আলা নেয়ামত দান করেছেন। এরা আদমের বংশধর এবং যাদেরকে আমি নূহের সাথে নৌকায় আরোহন করিয়েছিলাম, তাদের বংশধর, এবং ইব্রাহীম ও ইসরাঈলের বংশধর এবং যাদেরকে আমি পথ প্রদর্শন করেছি ও মনোনীত করেছি, তাদের বংশোদ্ভূত। তাদের কাছে যখন দয়াময় আল্লাহর আয়াতসমূহ পাঠ করা হত, তখন তারা সেজদায় লুটিয়ে পড়ত এবং ক্রন্দন করত। -১৯:৫৮

إِنَّ إِبْرَاهِيمَ لَحَلِيمٌ أَوَّاهٌ مُنِيبٌ

নিঃসন্দেহ ইবরাহীম তো ছিলেন সহনশীল, কোমল হৃদয়, সতত প্রত্যাবর্তনকারী। -১১:৭৫

وَمَا كَانَ اسْتِغْفَارُ إِبْرَاهِيمَ لِأَبِيهِ إِلَّا عَنْ مَوْعِدَةٍ وَعَدَهَا إِيَّاهُ فَلَمَّا تَبَيَّنَ لَهُ أَنَّهُ عَدُوٌّ لِلَّهِ تَبَرَّأَ مِنْهُ إِنَّ إِبْرَاهِيمَ لَأَوَّاهٌ حَلِيمٌ

আর ইব্রাহীম কর্তৃক স্বীয় পিতার মাগফেরাত কামনা ছিল কেবল সেই প্রতিশ্রুতির কারণে, যা তিনি তার সাথে করেছিলেন। অতঃপর যখন তাঁর কাছে একথা প্রকাশ পেল যে, সে আল্লাহর শত্রু তখন তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে নিলেন। নিঃসন্দেহে ইব্রাহীম ছিলেন বড় কোমল হৃদয়, সহনশীল। -৯:১১৪

وَلَقَدْ آَتَيْنَا إِبْرَاهِيمَ رُشْدَهُ مِنْ قَبْلُ وَكُنَّا بِهِ عَالِمِينَ

আর, আমি ইতিপূর্বে ইবরাহীমকে তার সৎপন্থা দান করেছিলাম এবং আমি তার সম্পর্কে সম্যক পরিজ্ঞাত ও ছিলাম। -২১:৫১

ইবরাহীমের বিরুদ্ধে ‘মিথ্যাচারিতার’ অভিযোগ

قَالُوا أَأَنْتَ فَعَلْتَ هَذَا بِآَلِهَتِنَا يَا إِبْرَاهِيمُ * قَالَ بَلْ فَعَلَهُ كَبِيرُهُمْ هَذَا فَاسْأَلُوهُمْ إِنْ كَانُوا يَنْطِقُونَ

তারা বললঃ হে ইবরাহীম তুমিই কি আমাদের উপাস্যদের সাথে এরূপ ব্যবহার করেছ? তিনি বললেনঃ বরং এদের এই প্রধানই তো একাজ করেছে। অতএব তাদেরকে জিজ্ঞেস কর, যদি তারা কথা বলতে পারে। -২১:৬২-৬৩

কথিত ‘আলেম-উলামা’ সম্প্রদায় সমাজে একটা অত্যন্ত গর্হিত এবং সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা চালু করেছে যে, হযরত ইবরাহীম নবী জীবন লাভের পরও ‘মিথ্যা’ বলেছিলেন – যা এই মহান নবীর প্রতি একেবারেই ডাহা মিথ্যাচার। যেখানে মুসলিম সমাজ হযরত ইবরাহীমকে ‘মিথ্যাবাদী’ প্রতিপন্ন করতে উঠেপড়ে লাগে; তখন আল্লাহ তাঁর প্রিয়তম নবীকে ‘সিদ্দীকান নাবিয়্যা’, অর্থাৎ সবচেয়ে সত্যবাদী নবী হিসেবে সত্যায়ন করেন।

মিথ্যা এমন কিছু যা দ্বারা কেউ কোন বিষয়ে তার সম্পৃক্ততা লুকাতে চায়। এখানে, নবী ইবরাহীমের অভিপ্রায় মোটেই তা ছিল না; বরং তিনি বাক্য বিন্যাসে এমন একটি পদ্ধতি প্রয়োগ করেছিলেন যা দ্বারা তিনি তাদের বিবেককে নাড়া দিতে চেয়েছিলেন যাতে তারা উপলব্ধি করতে পারে। সেই মূর্তিপূজকেরাও এটা বিশ্বাস করত না যে, তাদের সবচেয়ে বড় দেবতা এই কর্ম করেছে যেহেতু সেটা করবার কোন ক্ষমতা তার নেই; তারা এটা ভাল করেই বোঝে যে এ জাতীয় কিছু তারা করতে পারে না।

হযরত ইবরাহীমের আল্লাহ প্রদত্ত এই বুদ্ধিমত্তায় যথেষ্ট কাজ হয়; তাঁর এই প্রশ্নে তাদের মাথা হেট হয়ে গেল।

ثُمَّ نُكِسُوا عَلَى رُءُوسِهِمْ لَقَدْ عَلِمْتَ مَا هَؤُلَاءِ يَنْطِقُونَ

অতঃপর উহাদের মস্তক অবনত হইয়া গেল এবং উহারা বলিল, ‘তুমি তো জানই যে, ইহারা কথা বলে না’। -২১:৬৫

নিজ হাতে দেবতাদেরকে ভেঙ্গে ফেলা সংক্রান্ত তথ্য গোপন করবার কোন ইচ্ছাই নবী ইবরাহীমের ছিল না যা একটু পরেই স্পষ্ট হয়ে যাবে; আর এর দ্বারা তারা লজ্জিত হবে।

প্রথমত, মূর্তিপূজকদের প্রশ্নের জবাবে ইবরাহীম একথা বলেন নাই যে, তিনি তা ভাঙ্গেন নি। বরং অতি অল্প সময়ের জন্য একটি যুক্তি-কৌশল (হুজ্জাত)-এর অবলম্বন করেছেন তাদের অবচেতন মনে আঘাত করে ভুল ভেঙ্গে দেবার জন্য।

যখন ইবরাহীমের বুদ্ধিমত্তার কাছে তারা হেরে গেল, তখন তিনি তাদের চূড়ান্ত আঘাত হানেন আর প্রকারান্তরে সেই আঘাতের মধ্য দিয়েই স্বীকার করে নেন যে, তিনিই ভাঙ্গার কাজটি করেছেন।

قَالَ أَفَتَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَنْفَعُكُمْ شَيْئًا وَلَا يَضُرُّكُمْ

ইবরাহীম বলিল, ‘তবে কি তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর ইবাদত কর যাহা তোমাদের কোন উপকার করিতে পারে না, ক্ষতিও করিতে পারে না”। -২১:৬৬

একটি দৃষ্টান্ত কল্পনা করা যাক।

কোন এক অফিসের বস তার অধিনস্ত পাঁচ কর্মীকে একটি কাজ সম্পন্ন করবার জন্য খুব তাগিদ দিলেন। একদিন, দু’দিন, তিনদিন পার হয়ে গেল; কেউ তা করল না। চতুর্থ দিন সবার অফিসে আগমনের পূর্বে বস নিজেই কাজটি সম্পন্ন করে অফিসে রেখে দিলেন।

নির্দিষ্ট পাঁচ কর্মী অফিসে এসে কাজটি দেখে একে অপরকে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হল, তাদের কেউ তা করে নি এবং তারা এটাও বুঝে গেল, কাজটি জরুরী ছিল বিধায় বস নিজেই তা নিষ্পন্ন করেছেন।

অতঃপর যখন বসের সঙ্গে তাদের দেখা হল, তাদের একজন বসকে বিনয়ের সাথে এবং অপরাধি মনে জানতে চাইল, তিনিই কাজটি করেছেন কিনা?

বস তখন সরাসরি অস্বীকার না করে কৌশলে উত্তর দিলেন, কাজটি তো তোমাদেরই করবার কথা, তোমাদের কেউই হয়ত করেছে।

যেহেতু, তারা ইতিমধ্যেই নিশ্চিত হয়েছে, তাদের কেউ তা করেনি, তাই বসের এই উত্তরে তারা প্রত্যেকেই যথেষ্ট লজ্জিত বোধ করবে।

আমাদের পারিবারিক, প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক জীবনে এ জাতীয় ঘটনা অনেক সময় ঘটে থাকে – যা আমরা অন্যকে কিছু উপলব্ধি করাতে, শিখাতে প্রয়োগ করে থাকি।

এই ঘটনা থেকে আমরা কেউ একথা বলব না যে, ঘটনার বস তার কর্মীদের কাছে ‘মিথ্যা’ কথা বলেছেন।

কোন বিষয়ে প্রাসঙ্গিক সকল আয়াত যাচাই-বাছাই ব্যতিরেকেই, মুসলিম সম্প্রদায় আমভাবে হযরত ইবরাহীমের উপর একটি ভয়াবহ কলঙ্ক আরোপ করে চলেছে যে, তিনি ‘মিথ্যা’ বলেছিলেন যা একেবারেই সত্য নয়। বরঞ্চ, এই প্রজ্ঞা আল্লাহ তাঁকে দান করেছিলেন যেমনটি কুরআনে বলা হয়েছে।

وَتِلْكَ حُجَّتُنَا آَتَيْنَاهَا إِبْرَاهِيمَ عَلَى قَوْمِهِ نَرْفَعُ دَرَجَاتٍ مَنْ نَشَاءُ إِنَّ رَبَّكَ حَكِيمٌ عَلِيمٌ

আর ইহা আমাদের যুক্তি-প্রমাণ যাহা ইবরাহীমকে দিয়াছিলাম তাহার সম্প্রদায়কে মুকাবিলায়; যাহাকে ইচ্ছা মর্যাদায় আমরা উন্নীত করি। নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞ। -৬:৮৩

আরও বলা হয়েছে।

وَلَقَدْ آَتَيْنَا إِبْرَاهِيمَ رُشْدَهُ مِنْ قَبْلُ

আমরা তো ইহার পূর্বে ইবরাহীমকে সৎপথের জ্ঞান দিয়াছিলাম। -২১:৫১

আল্লাহ তা’য়ালা ইবরাহীমের ব্যাপারে তাঁর পক্ষ থেকে ‘সালাম’ বর্ষণের ঘোষণাও দিয়েছেন।

سَلَامٌ عَلَى إِبْرَاهِيمَ

ইবরাহীমের উপর সালাম। -৩৭:১০৯

হযরত মূসা

হযরত মূসা একজন ঝগড়াটে মিশরীয়কে অনিচ্ছাকৃতভাবে মেরে ফেলেছিলেন, আর সেজন্যে তিনি তাঁর জীবিতাবস্থায় যথেষ্ট অনুতপ্ত ছিলেন। আল্লাহ নবীর এই আক্ষেপ-অনুশোচনার বিষয়টিকে উদ্দেশ্য করে মহান নবীকে শান্তনা দিয়েছেন।

وَقَتَلْتَ نَفْسًا فَنَجَّيْنَاكَ مِنَ الْغَمِّ وَفَتَنَّاكَ فُتُونًا فَلَبِثْتَ سِنِينَ فِي أَهْلِ مَدْيَنَ ثُمَّ جِئْتَ عَلَى قَدَرٍ يَا مُوسَى

তুমি এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলে, অতঃপর আমি তোমাকে এই দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দেই; আমি তোমাকে অনেক পরীক্ষা করেছি। অতঃপর তুমি কয়েক বছর মাদইয়ান বাসীদের মধ্যে অবস্থান করেছিলে; হে মূসা, অতঃপর তুমি নির্ধারিত সময়ে এসেছ। -২০:৪০

وَدَخَلَ الْمَدِينَةَ عَلَى حِينِ غَفْلَةٍ مِنْ أَهْلِهَا فَوَجَدَ فِيهَا رَجُلَيْنِ يَقْتَتِلَانِ هَذَا مِنْ شِيعَتِهِ وَهَذَا مِنْ عَدُوِّهِ فَاسْتَغَاثَهُ الَّذِي مِنْ شِيعَتِهِ عَلَى الَّذِي مِنْ عَدُوِّهِ فَوَكَزَهُ مُوسَى فَقَضَى عَلَيْهِ قَالَ هَذَا مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ عَدُوٌّ مُضِلٌّ مُبِينٌ * قَالَ رَبِّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي فَاغْفِرْ لِي فَغَفَرَ لَهُ إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ

সে (মূসা) শহরে প্রবেশ করল, যখন তার অধিবাসীরা ছিল বেখবর। তথায় তিনি দুই ব্যক্তিকে লড়াইরত দেখল। এদের একজন ছিল তাঁর নিজ দলের এবং অন্য জন তাঁর শত্রু দলের। অতঃপর যে তাঁর নিজ দলের সে তাঁর শত্রু দলের লোকটির বিরুদ্ধে তাঁর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করল। তখন মূসা তাকে ঘুষি মারল এবং এতেই তার মৃত্যু হয়ে গেল। মূসা বলল, এটা শয়তানের কাজ। নিশ্চয় সে প্রকাশ্য শত্রু, বিভ্রান্তকারী। সে বলল, হে আমার পালনকর্তা, আমি তো নিজের উপর জুলুম করে ফেলেছি। অতএব, আমাকে ক্ষমা করুন। আল্লাহ তাকে ক্ষমা করলেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, দয়ালু। -২৮:১৫-১৬

কুরআনে আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষণা, সুনির্দিষ্ট সেই ঘটনার প্রেক্ষাপটে মূসা নবীর অনুতাপ-আক্ষেপের বদৌলতে আল্লাহ তাঁকে ক্ষমার ঘোষণা দিয়েছেন। হযরত নূহ এবং ইবরাহীমের মত, আল্লাহ তাঁর বিষয়েও ঘোষণা করেন।

سَلَامٌ عَلَى مُوسَى وَهَارُونَ

মূসা এবং হারুনের প্রতি সালাম। – ৩৭:১২০

হযরত ঈসা

শাফায়াতের দায়িত্ব গ্রহণ না করার ব্যাপারে হাদীসের বর্ণনায় হযরত ঈসা কোন কারণের কথা বলবেন না; শুধু ‘ইয়া নাফসি’, ‘ইয়া নাফসি’ করতে থাকবেন। কোন কারণ ছাড়াই তিনি কিয়ামতবাসীকে ফিরিয়ে দিবেন।

“নিঃসন্দেহ ঈসার দৃষ্টান্ত হচ্ছে আল্লাহ্‌র কাছে আদমের দৃষ্টান্তের মতো। তিনি তাঁকে সৃষ্টি করেছিলেন মাটি থেকে; তারপর তাঁকে বলেছিলেন- ‘হও’ আর তিনি হয়ে গেলেন”। -৩:৫৯

বহু নবী-রাসূলগণের উপর হযরত মূসা-ঈসার মর্যাদার প্রাধান্য বলতে গিয়ে আল্লাহ বলেন-

تِلْكَ الرُّسُلُ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ مِنْهُمْ مَنْ كَلَّمَ اللَّهُ وَرَفَعَ بَعْضَهُمْ دَرَجَاتٍ وَآَتَيْنَا عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ الْبَيِّنَاتِ وَأَيَّدْنَاهُ بِرُوحِ الْقُدُسِ

এইসব রাসূল- তাঁদের কাউকে আমরা অপর কারোর উপরে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি। তাঁদের মধ্যে কারোর সাথে আল্লাহ কথা বলেছেন এবং তাঁদের কাউকে তিনি বহুস্তর উন্নত করেছেন। আর আমরা মরিয়মের পুত্র ঈসাকে দিয়েছিলাম স্পষ্ট প্রমাণাবলী, আর আমরা তাঁকে বলীয়ান করি রূহুল কুদুস দিয়ে। -২:২৫২

এভাবে এক এক করে মহান নবীগণের গৌরব ও মহিমা লিখতে গেলে নিবন্ধের কলেবর অনেক বৃদ্ধি পাবে।

শেষকথা

শাফায়াতে কুবরা নামক ‘হাদীসের’ বর্ণনায় যে বিষয়গুলোকে বিশাল ‘অপরাধ’ হিসেবে উপস্থাপন করে মহান নবীগণকে শেষনবীর মোকাবেলায় ‘ছোট’ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে, তা কুরআনে বর্ণিত তাঁদের প্রতি আল্লাহর অকুণ্ঠ অনুগ্রহ ও দয়ার বিপরীতে কোনভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি, একগুচ্ছ অত্যন্ত খোঁড়া অজুহাত আরোপ করা হয়েছে আল্লাহর মহান নবীগণের উপর ধর্মের দূর্বৃত্তদের দ্বারা। যখন কুরআন তার চিরসত্য দ্বারা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, তখন এইসব ‘হাদীসের’ সনদের বিশুদ্ধতা অন্বেষণ করে তা সহীহ নাকি গলদ সে সিদ্ধান্ত নেয়া একেবারেই নির্বুদ্ধিতা। যখন কুরআন একাই এই বক্তব্যের অসারতা ধরিয়ে দেয়, তখন দ্বিতীয় আর সূত্রের দরকার পড়ে না তার সত্যাসত্য নির্ণয়ে।

তাই দেখা যাচ্ছে, ইসলামী লেবাসের মুনাফিকের দল একটি মিথ্যা আবিস্কার করেছে, অতঃপর সেই মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করতে আরও হাজারটি মিথ্যাকে তার চারপাশে খুঁটি হিসেবে দাঁড় করিয়েছে।

শাফায়াত কে কার জন্য কতটুকু করতে পারবেন, তা কিয়ামতের দিবসই বলে দিবে। বরং শেষনবী আমাদের বিরুদ্ধে কিয়ামতের দিন কুরআন বর্জনের অভিযোগ দায়ের করবেন- যে কুরআন আল্লাহ মানবজাতির প্রতি তাঁর করুণা এবং অনুগ্রহ এবং নেয়ামত হিসেবে পাঠিয়েছেন। আল্লাহ মেহেরবানি করে তা আগেভাগেই আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন।

وَقَالَ الرَّسُولُ يَا رَبِّ إِنَّ قَوْمِي اتَّخَذُوا هَذَا الْقُرْآَنَ مَهْجُورًا

রাসূল বললেনঃ হে আমার পালনকর্তা, আমার সম্প্রদায় এই কুরআনকে পরিত্যক্ত সাব্যস্ত করেছে। -২৫:৩০

শাফায়াত সংক্রান্ত সম্পূর্ণ মিথ্যা “সহীহ হাদীস”

সুতরাং, আল্লাহর রাসূলের নামে চালানো এই ভাষ্য কখনও রাসূলের সত্য ভাষণ হতে পারে না; বরং তা একটি ‘লাহওয়াল হাদীস’ বা অসার ও মনগড়া কথামালা। যদি কেউ এই বর্ণনাকে ‘সহীহ’ বলে দাবী করে তবে তাদের কাছে কুরআন বাতিল বলেই গণ্য হবে। ‘শাফায়াতে কুবরাকে’ প্রচলিত মানদন্ডে ‘সহীহ হাদীস’ হিসেবে চালানো হলেও কুরআনী মানদন্ডে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমানিত।

শেষনবীর নামে ‘সর্বশ্রেষ্ঠত্বের’ মিথ্যাকে লালন-পালন এবং রক্ষা করতে মুসলিম উম্মাহর এক বড় অংশ প্রতিনিয়ত আল্লাহর সকল মহান নবী-রাসূলগণকে হেয় ও ছোট করে চলেছে যাদেরকে নবী মুহাম্মদও আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী এক্তেদা ও এত্তেবা করে গেছেন।

সর্বশেষ নবীর সর্বশ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে ডা. জাকির নায়েক আমাকে এই ‘হাদীসের’ উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন। আমি তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, নবীর শ্রেষ্ঠত্বের কথা জেনেও কিয়ামতের দিন তিনি এবং তার মত আদম সন্তানেরা কেন শেষনবীর কাছে শাফায়তের জন্য প্রথমেই না গিয়ে আদিপিতা আদম এবং অন্যান্যদের কাছে যাবেন? কীভাবে আদম সন্তানেরা সর্বশেষ নবীর নাম ভুলে গিয়ে আদমের কথা মনে করবে? কোনো আহাম্মক, বেওকুফ ব্যতীত এ জাতীয় চিন্তার প্রশ্রয় কেউ কি দিতে পারে? গল্পটির অন্তঃসারশূন্যতা কি আমাদের দিব্য চোখে ধরা পড়ে না? আমাদের কী কোনই আকল নেই?

শেষনবী ও রাসূলকে আমাদের কারও উপর উকিল নিযুক্ত করা হয় নাই।

قُلْ يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَكُمُ الْحَقُّ مِنْ رَبِّكُمْ فَمَنِ اهْتَدَى فَإِنَّمَا يَهْتَدِي لِنَفْسِهِ وَمَنْ ضَلَّ فَإِنَّمَا يَضِلُّ عَلَيْهَا وَمَا أَنَا عَلَيْكُمْ بِوَكِيلٍ () وَاتَّبِعْ مَا يُوحَى إِلَيْكَ وَاصْبِرْ حَتَّى يَحْكُمَ اللَّهُ وَهُوَ خَيْرُ الْحَاكِمِينَ

বলে দাও, হে মানবকুল, সত্য তোমাদের কাছে পৌঁছে গেছে তোমাদের পরওয়ারদেগারের তরফ থেকে। এমন যে কেউ পথে আসে সে পথ প্রাপ্ত হয় স্বীয় মঙ্গলের জন্য। আর যে বিভ্রান্ত ঘুরতে থাকে, সে স্বীয় অমঙ্গলের জন্য বিভ্রান্ত অবস্থায় ঘুরতে থাকবে। অনন্তর আমি তোমাদের উপর অধিকারী নই। আর তুমি চল সে অনুযায়ী যেমন নির্দেশ আসে তোমার প্রতি এবং সবর কর, যতক্ষণ না ফয়সালা করেন আল্লাহ। বস্তুতঃ তিনি হচ্ছেন সর্বোত্তম ফয়সালাকারী। -১০:১০৮-১০৯

সাফায়াত সংক্রান্ত কতিপয় কুরআনী আয়াত
———————————————

শাফায়াত সম্পর্কিত আমাদের সমাজে বিদ্যমান প্রচলিত বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণাকে রদ করে কুরআন আমাদেরকে ভিন্ন ও সুস্পষ্ট জ্ঞান প্রদান করে। অত্যন্ত দ্ব্যর্থহীন ভাবে জানিয়ে দেয়া হয় যে, শাফায়াত সম্পর্কিত পূর্ণ এখতিয়ার একমাত্র আল্লাহরই নিকট সমর্পিত।

আল্লাহ ব্যতীত কোন সুপারিশকারী নেই

مَا لَكُمْ مِنْ دُونِهِ مِنْ وَلِيٍّ وَلَا شَفِيعٍ أَفَلَا تَتَذَكَّرُونَ

আল্লাহ যিনি নভোমন্ডল, ভুমন্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছু ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তিনি আরশে বিরাজমান হয়েছেন। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোন অভিভাবক ও সুপারিশকারী নেই। এরপরও কি তোমরা বুঝবে না? -৩২:৪

أَمِ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِ اللَّهِ شُفَعَاءَ قُلْ أَوَلَوْ كَانُوا لَا يَمْلِكُونَ شَيْئًا وَلَا يَعْقِلُونَ

তারা কি আল্লাহ ব্যতীত সুপারিশকারী গ্রহণ করেছে? বলো, তাদের কোন এখতিয়ার না থাকলেও এবং তারা না বুঝলেও? -৩৯:৪৩

وَلَا يَمْلِكُ الَّذِينَ يَدْعُونَ مِنْ دُونِهِ الشَّفَاعَةَ إِلَّا مَنْ شَهِدَ بِالْحَقِّ وَهُمْ يَعْلَمُونَ

তিনি ব্যতীত তারা যাদের পুজা করে, তারা সুপারিশের অধিকারী হবে না, তবে যারা সত্য স্বীকার করত ও বিশ্বাস করত। -৪৩:৮৬

وَأَنْذِرْ بِهِ الَّذِينَ يَخَافُونَ أَنْ يُحْشَرُوا إِلَى رَبِّهِمْ لَيْسَ لَهُمْ مِنْ دُونِهِ وَلِيٌّ وَلَا شَفِيعٌ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ

তুমি এ কুরআন দ্বারা তাদেরকে ভয়-প্রদর্শন করো, যারা আশঙ্কা করে স্বীয় পালনকর্তার কাছে এমতাবস্থায় একত্রিত হওয়ার যে, তাদের কোন সাহায্যকারী ও সুপারিশকারী হবে না- যাতে তারা গোনাহ থেকে বেঁচে থাকে। -৬:৫১

وَذَكِّرْ بِهِ أَنْ تُبْسَلَ نَفْسٌ بِمَا كَسَبَتْ لَيْسَ لَهَا مِنْ دُونِ اللَّهِ وَلِيٌّ وَلَا شَفِيعٌ

আর এ দ্বারা স্মরণ করিয়ে দাও পাছে কোনো প্রাণ বিধবস্ত হয়ে যায় যা সে অর্জন করে তার দ্বারা, তার জন্য আল্লাহকে ছেড়ে দিয়ে অন্য কোনো অভিভাবক থাকবে না, আর না কোনো সুপারিশকারী। -৬:৭০

وَيَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَضُرُّهُمْ وَلَا يَنْفَعُهُمْ وَيَقُولُونَ هَؤُلَاءِ شُفَعَاؤُنَا عِنْدَ اللَّهِ قُلْ أَتُنَبِّئُونَ اللَّهَ بِمَا لَا يَعْلَمُ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ

আর ওরা আল্লাহকে ছেড়ে দিয়ে তার উপাসনা করে যা তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারে না বা তাদের উপকারও করতে পারে না, আর তারা বলে- এরা আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশকারী। বলো- তোমরা কি আল্লাহকে জানাতে চাও যা তিনি জানেন না মহাকাশে আর পৃথিবীতেও না? তারঁই সব মহিমা! আর তারা যাকে অংশী করে তা হতে তিনি বহু ঊর্ধ্বে। -১০:১৮

কিয়ামতের দিনকে মোকাবেলায় কুরআন সবাইকে ব্যক্তিগত প্রস্তুতির জন্য তাগিদ দেয়

يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَلَا يَشْفَعُونَ إِلَّا لِمَنِ ارْتَضَى وَهُمْ مِنْ خَشْيَتِهِ مُشْفِقُونَ

তাদের সম্মুখে ও পশ্চাতে যা আছে, তা তিনি জানেন। তারা শুধু তাদের জন্যে সুপারিশ করে, যাদের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট এবং তারা তাঁর ভয়ে ভীত। -২১:২৮

وَاتَّقُوا يَوْمًا لَا تَجْزِي نَفْسٌ عَنْ نَفْسٍ شَيْئًا وَلَا يُقْبَلُ مِنْهَا شَفَاعَةٌ وَلَا يُؤْخَذُ مِنْهَا عَدْلٌ وَلَا هُمْ يُنْصَرُونَ

আর সে দিনের ভয় কর, যখন কেউ কারও সামান্য উপকারে আসবে না এবং তার পক্ষে কোন সুপারিশও কবুল হবে না; কারও কাছ থেকে ক্ষতিপূরণও নেয়া হবে না এবং তারা কোন রকম সাহায্যও পাবে না। -২:৪৮

وَاتَّقُوا يَوْمًا لَا تَجْزِي نَفْسٌ عَنْ نَفْسٍ شَيْئًا وَلَا يُقْبَلُ مِنْهَا عَدْلٌ وَلَا تَنْفَعُهَا شَفَاعَةٌ وَلَا هُمْ يُنْصَرُونَ

তোমরা ভয় কর সেদিনকে, যে দিন এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তি বিন্দুমাত্র উপকৃত হবে না, কারও কাছ থেকে বিনিময় গৃহীত হবে না, কার ও সুপারিশ ফলপ্রদ হবে না এবং তারা সাহায্য প্রাপ্ত ও হবে না। -২:১২৩

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا أَنْفِقُوا مِمَّا رَزَقْنَاكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَ يَوْمٌ لَا بَيْعٌ فِيهِ وَلَا خُلَّةٌ وَلَا شَفَاعَةٌ وَالْكَافِرُونَ هُمُ الظَّالِمُونَ

হে ঈমানদারগণ! আমি তোমাদেরকে যে রুযী দিয়েছি, সেদিন আসার পূর্বেই তোমরা তা থেকে ব্যয় কর, যাতে না আছে বেচা-কেনা, না আছে সুপারিশ কিংবা বন্ধুত্ব। আর কাফেররাই হলো প্রকৃত যালেম। -২:২৫৪

কোন সুপারিশকারীর সুপারিশে উপকার আসবে না

أَأَتَّخِذُ مِنْ دُونِهِ آَلِهَةً إِنْ يُرِدْنِ الرَّحْمَنُ بِضُرٍّ لَا تُغْنِ عَنِّي شَفَاعَتُهُمْ شَيْئًا وَلَا يُنْقِذُونِ

আমি কি তাঁর পরিবর্তে অন্যান্যদেরকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করব? করুণাময় যদি আমাকে কষ্টে নিপতিত করতে চান, তবে তাদের সুপারিশ আমার কোনই কাজে আসবে না এবং তারা আমাকে রক্ষাও করতে পারবে না। -৩৬:২৩

وَكَمْ مِنْ مَلَكٍ فِي السَّمَاوَاتِ لَا تُغْنِي شَفَاعَتُهُمْ شَيْئًا إِلَّا مِنْ بَعْدِ أَنْ يَأْذَنَ اللَّهُ لِمَنْ يَشَاءُ وَيَرْضَى

আকাশে অনেক ফেরেশতা রয়েছে। তাদের কোন সুপারিশ ফলপ্রসূ হয় না যতক্ষণ আল্লাহ যার জন্যে ইচ্ছা ও যাকে পছন্দ করেন, অনুমতি না দেন। -৫৩:২৬

فَمَا تَنْفَعُهُمْ شَفَاعَةُ الشَّافِعِينَ

অতএব, সুপারিশকারীদের সুপারিশ তাদের কোন উপকারে আসবে না। -৭৪:৪৮

وَلَمْ يَكُنْ لَهُمْ مِنْ شُرَكَائِهِمْ شُفَعَاءُ وَكَانُوا بِشُرَكَائِهِمْ كَافِرِينَ

তাদের দেবতা গুলোর মধ্যে কেউ তাদের সুপারিশ করবে না। এবং তারা তাদের দেবতাকে অস্বীকার করবে। -৩০:১৩

وَأَنْذِرْهُمْ يَوْمَ الْآَزِفَةِ إِذِ الْقُلُوبُ لَدَى الْحَنَاجِرِ كَاظِمِينَ مَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ حَمِيمٍ وَلَا شَفِيعٍ يُطَاعُ

আপনি তাদেরকে আসন্ন দিন সম্পর্কে সতর্ক করুন, যখন প্রাণ কন্ঠাগত হবে, দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হবে। পাপিষ্ঠদের জন্যে কোন বন্ধু নেই এবং সুপারিশকারীও নেই; যার সুপারিশ গ্রাহ্য হবে। -৪০:১৮

অতএব, আর বেশি বাক্যব্যয় নয়। বাজারে প্রচলিত ‘শাফায়াতের’ গল্পে ভুলে আমরা যেন আমাদের বিচার দিবসের প্রস্তুতির বিষয়ে উদাসীন-গাফেল হয়ে না যাই। আল্লাহই সম্যক অবগত।

[আমার লেখার বিপরীতে ডা. জাকির নায়েক কর্তৃক এই হাদীস দিয়ে শেষনবীর সর্বশ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদনের উত্তরে লিখিত। ইমাম-আলেম-উলামা, স্কলার দাবীদার সকলের কর্তব্য কুরআন দিয়ে এই লেখায় যদি কোন ভুল থাকে তা ধরিয়ে সংশোধন করে দেয়া; আর যদি তা শুদ্ধ বলে প্রতিয়মান হয়, তবে এই সত্যকে স্বীকার করে নিয়ে জনসমক্ষে ঘোষণা দিয়ে তা জানিয়ে দেয়া।]

*******************************

Intercession Qubra.bn

কুরআনের আলোকে কথিত “শাফায়াতে কুবরা” (কিঞ্চিত পরিমার্জিত)
-আবু সাঈদ খান
*****************************

https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=2757859010913203&id=100000673936418

*****************************

মুসলিম সমাজে ব্যাপকভাবে একটি বিশ্বাস চালু করে দেয়া হয়েছে যে, ‘হাদীস’ বলতে যা বোঝানো হয়, তা হল কুরআনের ব্যাখ্যা। শাফায়াত বা সুপারিশ সম্পর্কে কুরআনিক শাশ্বত বিবৃতি বহু। একইভাবে শাফায়াত সংক্রান্ত অনেকগুলো বর্ণনা আমরা প্রচলিত ‘হাদীস’ গ্রন্থগুলোতে পাই – এর মধ্যে অন্যতম যেটি, তা ‘শাফায়াতে কুবরা’ বা বড় শাফায়াত নামে পরিচিত। কুরআনে শাফায়াত নিয়ে কোনো আয়াতের বিপরীতে হয়ত এটিকে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে।

শাফায়াত সম্পর্কিত ‘হাদীসের’ বর্ণনায় এমন ‘সহীহ’ দাবীকৃত বিবৃতিও রয়েছে, কিয়ামতের দিন আল্লাহর পক্ষ থেকে জাহান্নাম নির্ধারিত হয়ে গেছে এমন ব্যক্তিকেও আল্লাহর শেষনবী তাঁর কথিত ‘কর্তৃত্ব’ বলে ছাড়িয়ে এনে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দিবেন। যদিও কুরআনে আল্লাহর দাবী সম্পূর্ণ উল্টো।

“আল্লাহ বলবেনঃ আমার সামনে বাকবিতন্ডা করো না আমি তো পূর্বেই তোমাদেরকে আযাব দ্বারা ভয় প্রদর্শন করেছিলাম। আমার কাছে কথা রদবদল হয় না এবং আমি বান্দাদের প্রতি জুলুমকারী নই।” -৫০:২৮-২৯

‘শাফায়াতুন’ পদটি কুরআনে ৩০ বার আবির্ভূত হয়েছে। এর অর্থ একটি কাজের সাথে আর একটি কাজকে যুক্ত করা; একজনের পক্ষ হয়ে কথা বলা, মধ্যস্থতা করা, ইত্যাদি। যেমন.

مَنْ يَشْفَعْ شَفَاعَةً حَسَنَةً يَكُنْ لَهُ نَصِيبٌ مِنْهَا وَمَنْ يَشْفَعْ شَفَاعَةً سَيِّئَةً يَكُنْ لَهُ كِفْلٌ مِنْهَا

যে লোক সৎকাজের জন্য কোন সুপারিশ করবে, তা থেকে সেও একটি অংশ পাবে। আর যে লোক সুপারিশ করবে মন্দ কাজের জন্যে সে তার বোঝারও একটি অংশ পাবে। বস্তুতঃ আল্লাহ সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাশীল। -৪:৮৫

শাফায়াতের পূর্ণ কর্তৃত্ব আল্লাহর

কুরআনে শাফায়াত সম্পর্কিত বিস্তৃত আলোচনা এসেছে। শাফায়াতের পূর্ণ কর্তৃত্ব আল্লাহর (৩৯:৪৪) জানিয়ে বলা হয়েছে যে, কেবলমাত্র সেই সুপারিশ করতে পারবে যাকে অনুমতি দেয়া হবে।

কার জন্য শাফায়াতের অনুমতি দেয়া হবে তার শর্তও বলে দেয়া হয়েছে।

مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ

কে আছ এমন, যে সুপারিশ করবে তাঁর কাছে তাঁর অনুমতি ছাড়া? -২:২৫৫

وَلَا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ عِنْدَهُ إِلَّا لِمَنْ أَذِنَ لَهُ

যার জন্যে অনুমতি দেয়া হয়, তার জন্যে ব্যতীত আল্লাহর কাছে কারও সুপারিশ ফলপ্রসূ হবে না। -৩৪:২৩

يَوْمَئِذٍ لَا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ إِلَّا مَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّحْمَنُ وَرَضِيَ لَهُ قَوْلًا

দয়াময় আল্লাহ যাকে অনুমতি দেবেন এবং যার কথায় সন্তুষ্ট হবেন সে ছাড়া কারও সুপারিশ সেদিন কোন উপকারে আসবে না। -২০:১০৯

مَا مِنْ شَفِيعٍ إِلَّا مِنْ بَعْدِ إِذْنِهِ ذَلِكُمُ اللَّهُ رَبُّكُمْ فَاعْبُدُوهُ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ

কেউ সুপারিশ করতে পারবে না তবে তাঁর অনুমতি ছাড়া; ইনিই আল্লাহ তোমাদের পালনকর্তা। অতএব, তোমরা তাঁরই এবাদত কর। তোমরা কি কিছুই চিন্তা কর না ? -১০:৩

এখানে ‘মান (مَنْ)’ বা যে কেউ বলতে সুনির্দিষ্ট করে কাউকে বোঝায় না। আল্লাহ পছন্দ করেন এমন যে কেউই তিনি হতে পারেন।

বস্তুতঃ পুরো কুরআন থেকে একটি আয়াত দ্বারাও কোনভাবে এটা প্রমাণ করা যাবে না যে, শাফায়াতের বিষয়ে শেষনবীকে অন্যান্যদের চেয়ে আলাদা কোন মর্যাদা, অধিকার বা এখতিয়ার প্রদান করা হয়েছে যা ‘শাফায়াতে কুবরা’ নামক কথিত ‘হাদীসের’ বর্ণনা দ্বারা আমাদের বিশ্বাস ও মননে অনুপ্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়েছে।

কুরআনের যে কোনো আয়াতের ব্যাখ্যা হিসেবেই ‘শাফায়াতে কুবরাকে’ দাড় করানো হোক না কেন, কুরআনের কষ্টিপাথরে যাচাই করলে শেষ পর্যন্ত তা টিকে কিনা তাই আমরা আলোচ্য নিবন্ধে প্রমাণ করতে চেষ্টা করব, ইনশা-আল্লাহ।

কেননা কুরআন আহসানা তাফসীর বা সর্বোত্তম ব্যাখ্যাকারী

কুরআনুল কারীম নিজেই নিজের উত্তম বিশ্লেষণকারী এবং যে কোন বিষয়ের সন্তোষজনক উত্তর প্রদানকারী। কুরআন বিশ্বের যে কোন মানুষের যে কোন ধরণের জিজ্ঞাসার বিপরীতে সর্বোত্তম ব্যাখ্যাকারী বা আহসানা তাফসীরা (أَحْسَنَ تَفْسِيرًا) বা “Best Explanation”।

وَلَا يَأْتُونَكَ بِمَثَلٍ إِلَّا جِئْنَاكَ بِالْحَقِّ وَأَحْسَنَ تَفْسِيرًا

উহারা তোমার নিকট এমন কোন সমস্যা উপস্থিত করে না, যাহার সঠিক সমাধান ও সুন্দর ব্যাখ্যা আমি তোমাকে প্রদান করি না। -২৫:৩৩

الر كِتَابٌ أُحْكِمَتْ آَيَاتُهُ ثُمَّ فُصِّلَتْ مِنْ لَدُنْ حَكِيمٍ خَبِيرٍ

আলিফ, লা-ম, রা; এটি এমন এক কিতাব, যার আয়াত সমূহ সুপ্রতিষ্ঠিত অতঃপর সবিস্তারে বর্ণিত এক মহাজ্ঞানী, সর্বজ্ঞ সত্তার পক্ষ হতে। -১১:১

কুরআনে এটাও উচ্চারিত হয়েছে যে, কুরআন হচ্ছে মানবজাতির জন্য চক্ষু-উন্মোচনকারী মহাগ্রন্থ। মানবজাতির জন্য তা আলোকবর্তিকাস্বরূপ (enlightenment and illumination)।

هَذَا بَصَائِرُ لِلنَّاسِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ

এই কুরআন মানবজাতির জন্য চক্ষু-উন্মোচনকারী এবং নিশ্চিত বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য পথনির্দেশ ও রহমত। -৪৫:২০; আরও ৭:২০৩

قَدْ جَاءَكُمْ بَصَائِرُ مِنْ رَبِّكُمْ فَمَنْ أَبْصَرَ فَلِنَفْسِهِ وَمَنْ عَمِيَ فَعَلَيْهَا وَمَا أَنَا عَلَيْكُمْ بِحَفِيظٍ

তোমাদের কাছে তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে নিদর্শনাবলী এসে গেছে। অতএব, যে প্রত্যক্ষ করবে, সে নিজেরই উপকার করবে এবং যে অন্ধ হবে, সে নিজেরই ক্ষতি করবে। আমি তোমাদের পর্যবেক্ষক নই। -৬:১০৪

অনুবাদকগণ বাছায়ির (بَصَائِرُ) পদের অনুবাদে বাংলা ও ইংরেজীতে যে শব্দসমূহ নির্বাচন করেছেন তা হল- সুস্পষ্ট দলীল, নিদর্শনাবলী, সূক্ষ্ন ও দৃষ্টিসম্পন্ন নিদর্শন বা ‘clear proofs’, ‘clear insights’, ‘eye-openers’, ‘enlightening proofs’, ‘means of insight’, ‘enlightenment’, ‘clear perception’, ‘illumination’, ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়েছে।

শাফায়াত সংক্রান্ত অতি জনপ্রিয় ‘হাদীস’

শাফায়াতে কুবরার ‘হাদীসটি’ অতি জনপ্রিয় এবং বলতে গেলে তা প্রায় সকল মুসলিমেরই জানা – কেননা প্রতিনিয়ত তা তাদেরকে শোনানো হয়ে থাকে। বিবৃতিটি এখানে সংক্ষেপে উদ্ধৃত করব এবং পরবর্তীতে তা কুরআনের চোখ দিয়ে দেখবার ও উপলব্ধি করবার চেষ্টা করব।

হাদীসটি একাধিক সূত্র থেকে বর্ণিত হয়েছে যেখান থেকে আমরা জানতে পারি যে, নবীজি বলেছেন, কিয়ামতের দিন আদম সন্তানগণ এত দীর্ঘসময় অপেক্ষারত থাকবে যে, তারা অস্থির, উদ্বিগ্ন এবং ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়বে। তারা তখন পরস্পর বলাবলি করবে যে, চল আমরা কাউকে আমাদের জন্য আমাদের প্রভুর কাছে সুপারিশ করতে অনুরোধ করি যাতে করে তিনি আমাদেরকে এই অবস্থা থেকে মুক্তি দেন।

অতঃপর তারা একে একে হযরত আদম, নূহ, ইবরাহীম, মূসা এবং ঈসা (সালামুন ‘আলাল মুরসালীন) কাছে সাফায়াতের আর্জি নিয়ে হাজির হবে। কিন্তু নবীগণের সকলেই সেই কাজে তাঁদের অপরাগতা প্রকাশ করবেন এক সাধারণ যুক্তিতে যে, আজ আমার প্রভু এতো বেশি ক্রোধান্বিত আছেন যা পূর্বে কখনো হননি, আর পরেও কখনো হবেন না। আল্লাহর কাছে সুপারিশ করতে অসমর্থতার জন্য তাঁরা এর সাথে তাদের যে ‘অপরাধের’ উল্লেখ করবেন তা সংক্ষেপে নীচে দেয়া হল-

আদিপিতা আদমঃ
আল্লাহ আমাকে একটি বৃক্ষের ফল খেতে নিষেধ করেছিলেন, আর আমি সেই নিষেধ লঙ্ঘন করে ফেলেছি, নাফসি! নাফসি! আজ আমি চিন্তায় পেরেশান। তোমরা অন্য কারো কাছে গিয়ে চেষ্টা করে। তোমরা বরং নূহের কাছে যাও।

প্রথম শরিয়তের অধিকারী এবং চির কৃতজ্ঞ বান্দা নূহঃ
আল্লাহ আমাকে একটি দোয়া কবুলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, আর তা আমি আমার জাতির বিরুদ্ধে প্রয়োগ করে ফেলেছি। অতঃপর ‘নাফসি, নাফসি’ বলতে বলতে তিনিও কিয়ামতবাসীকে হযরত ইবরাহীমের কাছে পাঠিয়ে দিবেন। অন্য বর্ণনায় আছে- নিজ সন্তানের ব্যাপারে না জেনেই আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার কারণে আল্লাহ যে তাঁর প্রতি নারাজ হয়েছিলেন- তিনি তার উল্লেখ করবেন।

[দোয়া কবুলের প্রতিশ্রুতি যদি আল্লাহ তাঁকে দিয়ে থাকেন; আর নবী নূহ যদি তা প্রয়োগ করে থাকেন তবে তা কেন তাঁর অপরাধ হতে যাবে?]

আল্লাহর খলীল, ইমাম, জাতির পিতা ও উত্তমাদর্শ ইবরাহীমঃ
মূর্তি ভাঙ্গার বিষয়ে ইবরাহীম তার ‘অসত্য কথনের’ উল্লেখ করে নিজের নফসের পেরেশানিতে অস্থির হয়ে হযরত মূসার কাছে পাঠিয়ে দিবেন। অর্থাৎ কথিত ‘অসত্য বচন বা মিথ্যা কথা’ কিয়ামতে শাফায়াত করার বিষয়ে তাঁর বড় অযোগ্যতা। [আলেম-উলামা সমাজ আমজনতাকে শেখায় হযরত ইবরাহীম ‘মিথ্যা’ বলেছিলেন।]

আল্লাহর সাথে কথোপকথনকারী মহান নবী মূসাঃ
নবী মূসা তাঁর দ্বারা এক ব্যক্তিকে মেরে ফেলার উল্লেখ করে ‘নাফসি-নাফসি’ বলে তার অপারগতা প্রকাশ করবেন এবং মানবজাতিকে হযরত ঈসার কাছে পাঠিয়ে দিবেন।

বহু বহু বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, রুহুল কুদুস দ্বারা সাহায্যপ্রাপ্ত ঈসা ইবনে মারইয়ামঃ
যেমনটি পূর্বের নবীগণ বলেছেন তেমনি তিনিও আল্লাহর ক্রোধের কথা, নিজের পেরেশানীর কথা বলবেন। কিন্তু তিনি তাঁর কোন অপরাধের কথা সুপারিশ করতে না পারার কারণ হিসেবে দেখাবেন না- ‘হাদীসের’ বর্ণনায় তা অনুপস্থিত। বরং কোন কারণ ছাড়াই তাদেরকে তিনি শেষনবী হযরত মুহাম্মদের (তাঁর উপর শান্তি) কাছে পাঠিয়ে দিবেন।

অতঃপর সকলে নবী মুহাম্মদের কাছে গিয়ে হাজির হবে, নবীজি রাজি হয়ে আল্লাহর সমীপে মস্তকাবনত করবেন আর আল্লাহ তাঁকে সুপারিশ করার অনুমতি দিবেন। এভাবেই ‘শাফায়াতে কুবরা’ নামের কিয়ামতের এই পর্ব সমাপ্ত হবে। [সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম]

এখন প্রতিটি মুসলমান মসজিদের মিম্বর এবং ‘ওয়াজের জলসা’ থেকে অহরহ এই বর্ণনা শোনে, আবার অন্যদেরকেও তা শোনায়; কিন্তু কেউ এটা নিয়ে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করতে সাহসী হয় না, যেহেতু তা রাসূলের ভাষ্য হিসেবে তাদেরকে শোনানো হয়।

তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল, কুরআন বিচ্ছিন্নতার কারণে মানুষ এর মধ্যে কোন গলদও খুঁজে পায় না। যদিও তাদের অবচেতন মনে এ জাতীয় বর্ণনা নিয়ে অবোধগম্য অনেক কিছুরই দ্যোতনা হতে থাকে।

অতি সাধারণ কিছু প্রশ্নঃ

উপরিউক্ত কথিত শাফায়াত সংক্রান্ত ‘হাদীসের’ বর্ণনার সবচেয়ে প্রহসনমূলক দিকটি হল, হযরত ঈসা ব্যতীত কোন নবীই ‘সঠিক উত্তর (?)’ দিতে সফল হয় না। সঠিক উত্তর মানে এখানে, যার কাছে গেলে প্রকৃত সমাধান মিলবে বলে ধরে নেয়া হচ্ছে তার নাম বলতে পারা। অথচ এটা ধরে নেয়া হয় যে, পূর্ববর্তী সকল নবীই শেষনবীর কথিত ‘সর্বশ্রেষ্ঠত্বের’ বিষয়টি অবগত ছিলেন।

এটাও বিশ্বাস করা হয়ে থাকে যে, পূর্ববর্তী সকল নবীগণই তাদের নবীত্ব বিসর্জন দিয়ে শেষনবীর কথিত ‘সর্বশ্রেষ্ঠত্বের’ কারণে তাঁর একজন সাধারণ ‘উম্মত’ হওয়ার গৌরব অর্জন করতে চেয়েছিলেন – সেই বিচারে তাদের নিজ নিজে উম্মতগণ এই সত্য সম্পর্কে পূর্ণ অবগত। যদি তাই হয়, তবে কিয়ামতের দিন প্রথম মানব আদম থেকে শুরু করে সকলেরই এটা জানা থাকবার কথা- তাহলে হযরত আদম বা হযরত নূহ সরাসরি শেষনবীর কথা না বলে শুধু তাঁর পরবর্তী নবীর কথা কেন বলবেন? যদি তাঁরা তাদের পরবর্তী নবীর নাম মনে রাখতে পারেন, তবে ‘সর্বশ্রেষ্ঠ’ নবী মুহাম্মাদের নাম কীভাবে ভুলে যাবেন? এটা কি ভুলে ভরা একটা মানব-রচিত প্রহসনের নাটক নয়?

আদিপিতা আদমের ক্ষেত্রে এটাও কথিত আছে যে, তিনি আল্লাহর ক্ষমা পেয়েছিলেন আল্লাহর আরশে দেখতে পাওয়া আল্লাহর নামের সাথে শেষনবীর নামের দোহাই দিয়ে (এটাও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন কথা এবং শুধু মিথ্যাচার নয়, বরং কঠিন শিরকপূর্ণ কথা)। যার নামের দোহাই দিয়ে নিজে মুক্তি পেয়েছেন বলে বর্ণনা আছে সেই আদম কীভাবে কিয়ামতের কঠিন ময়দানে মানুষকে বিভ্রান্ত করে শেষনবীর কথা না বলে তাঁর পরবর্তী নূহ নবীর কথা বলতে পারেন?

আরও পরিহাস হল, শেষনবীর উম্মত দাবীদার যারা, তারা তো তাদের নবীর সর্বশ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে সম্যক অবগত। তারা কিয়ামতের কঠিন দিনে সময় ক্ষেপণ করে সরাসরি শেষনবীর কাছে না গিয়ে কেন পাঁচ-পাঁচজন নবীর কাছে গিয়ে বৃথা সময় নষ্ট করবে? তাদের তো কর্তব্য পূর্ববর্তী সকল নবীর উম্মতগণকে নেতৃত্ব দিয়ে সরাসরি শেষনবীর কাছে পৌঁছানো। তারা আদিপিতা আদমকে স্মরণ করতে বা মনে রাখতে পারবে, আর তাঁদের দাবীকৃত ‘সর্বশ্রেষ্ঠ’ নবী মুহাম্মদকে মনে রাখতে পারবে না? বাংলায় যাকে আমরা আঁষাঢ়ে গল্প বলি- এটা যেন ঠিক তাই।

আরও বলা হয়ে থাকে যে, মৃত্যুর পর কবরে কতিপয় প্রশ্ন করা হবে, যার একটি – মান নাবিয়্যুকা (তোমার নবী কে?)। ঈমানদারগণ এই প্রশ্নের সঠিক উত্তরে শেষনবীর নাম বলে দেবে। অথচ কী আশ্চর্য যে, এরাই সেই মহান নবীর নাম ভুলে গিয়ে কিয়ামতের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত চষে বেড়াবে ‘মুক্তিদাতার’ অন্বেষায়!

এখন আমরা একটু পেছনে ফিরে তাকাতে চেষ্টা করব, কিয়ামতের ময়দানের কথিত প্রেক্ষাপটে নবীগণ যে সকল কারণ দেখিয়ে তাদের অসহায়ত্বের কথা প্রকাশ করবেন তার ভিত্তি কী? সুপারিশ করতে অসমর্থতার জন্য যে সব কারণ তাদের মুখ দ্বারা আলোচ্য ‘হাদীসে’ বলানো হয়েছে, যদি তা যথার্থ হয় তবে এটা নিশ্চিত যে, শেষনবী নিজেও নিদেনপক্ষে নিম্নোক্ত ৭ টি কারণে আমাদের জন্য সেদিন সুপারিশের লক্ষ্যে উদ্যোগী হতে সাহসী হবেন না।

১. শেষনবী কর্তৃক ‘অভিশাপ’ দেবার ঘটনা

অহুদের যুদ্ধে নবী মুহাম্মদ (তাঁর উপর শান্তি) অত্যন্ত সঙ্গীন এবং প্রতিকুল পরিস্থিতিতে কতিপয় অবিশ্বাসী কাফিরের নাম উল্লেখপূর্বক অভিশাপ বা লা’নত প্রদান করেন। বিষয়টি আল্লাহ একেবারেই সমর্থন করেন নি এবং নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল করে সতর্ক করে দেন যে, এ কাজের কোন কর্তৃত্ব তাঁর নেই।

لَيْسَ لَكَ مِنَ الْأَمْرِ شَيْءٌ أَوْ يَتُوبَ عَلَيْهِمْ أَوْ يُعَذِّبَهُمْ فَإِنَّهُمْ ظَالِمُونَ

হয় আল্লাহ তাদের ক্ষমা করবেন কিংবা তাদেরকে আযাব দেবেন। এ ব্যাপারে তোমার কোন এখতিয়ার নাই। কারণ তারা রয়েছে অন্যায়ের উপর। -৩:১২৮

২. দরিদ্র এবং দাসশ্রেণীর মু’মিনদের মসজিদ থেকে বিতাড়ন

একদা কিছু কুরাইশ আরব সর্দার নবীজির সাক্ষাতপ্রার্থী হয় যখন তিনি মসজিদে মু’মিনদের সাথে আলাপরত ছিলেন যাদের অধিকাংশই ছিলেন হতঃদরিদ্র এবং দাসশ্রেণীর – যারা ‘আছহাবে ছুফ্ফা’ নামে পরিচিত। কুরাইশ সর্দারগণ রাসূলের সাথে তাদের দৃষ্টিতে নিম্নজাতের এই মানুষগুলোকে দেখে তাদের পাশে বসে রাসূলের সাথে কথা বলতে আপত্তি জানায় এবং তাদেরকে প্রথমে বের করে দেবার শর্ত প্রয়োগ করে; কেননা কেউ কেউ পূর্বে তাদের দাস ছিলেন। রাসূল এতে সম্মতি না দিলে ছাহাবী ওমরের পরামর্শে শেষপর্যন্ত রাসূল তাদেরকে ঐ সময়ের জন্য বাইরে যেতে বলেন। আর সেই সব মু’মিন ছাহাবীগণ আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের এতই অনুগত ছিলেন যে, রাসূলের সকল নির্দেশ মেনে নেবার জন্য তাঁরা সদা প্রস্তুত ছিলেন।

কিন্তু এই আচরণটি আল্লাহর একেবারেই পছন্দ হয় নি; শুধু তাই নয় তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছেন- তার সুস্পষ্ট প্রকাশ আমরা নাযিলকৃত আয়াতেই দেখতে পাব।

وَلَا تَطْرُدِ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ مَا عَلَيْكَ مِنْ حِسَابِهِمْ مِنْ شَيْءٍ وَمَا مِنْ حِسَابِكَ عَلَيْهِمْ مِنْ شَيْءٍ فَتَطْرُدَهُمْ فَتَكُونَ مِنَ الظَّالِمِينَ

আর তাদেরকে বিতাড়িত করবে না, যারা সকাল-বিকাল স্বীয় পালকর্তার এবাদত করে, তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে। তাদের হিসাব বিন্দুমাত্রও তোমার দায়িত্বে নয় এবং তোমার হিসাব বিন্দুমাত্রও তাদের দায়িত্বে নয় যে, তুমি তাদেরকে বিতাড়িত করবে। নতুবা তুমি জালিমদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাবে। -৬:৫২

এ হেন ঘটনা পূর্ববর্তী নবীদের আমলেও ঘটেছে, তার দৃষ্টান্ত কুরআনে পাওয়া যায়। প্রায় সমজাতীয় ঘটনার প্রেক্ষাপটে সালামুন ‘আলা নূহ দরিদ্র শ্রেণীর মু’মিনদিগকে বের না করে দিয়ে বলেন-

إِنْ حِسَابُهُمْ إِلَّا عَلَى رَبِّي لَوْ تَشْعُرُونَ * وَمَا أَنَا بِطَارِدِ الْمُؤْمِنِينَ

আমি মুমিনগণকে তাড়িয়ে দেয়ার লোক নই। -২৬:১১৪

وَمَا أَنَا بِطَارِدِ الَّذِينَ آَمَنُوا إِنَّهُمْ مُلَاقُو رَبِّهِمْ وَلَكِنِّي أَرَاكُمْ قَوْمًا تَجْهَلُونَ * وَيَا قَوْمِ مَنْ يَنْصُرُنِي مِنَ اللَّهِ إِنْ طَرَدْتُهُمْ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ

আমি কিন্তু ঈমানদারদের তাড়িয়ে দিতে পারি না। তারা অবশ্যই তাদের পালনকর্তার সাক্ষাত লাভ করবে। বরঞ্চ তোমাদেরই আমি অজ্ঞ সম্প্রদায় দেখছি। আর হে আমার জাতি! আমি যদি তাদের তাড়িয়ে দেই তাহলে আমাকে আল্লাহ হতে রেহাই দেবে কে? তোমরা কি চিন্তা করে দেখ না? -১১:২৯-৩০

৩. একজন অন্ধ মু’মিন ছাহাবী থেকে ভ্রুকুঞ্চন করে মুখ ফিরিয়ে নেয়া

কোন এক কুরআনী জলসায় রাসূল অনেকের উদ্দেশ্যে বক্তব্য পেশ করছিলেন- যেখানে মু’মিন-মুসলিমদের সাথে কাফের নেতৃবৃন্দও ছিল। এমন অবস্থায় সেখানে এক অন্ধ মু’মিন ছাহাবী এসে হাজির হন এবং রাসূলের কাছে দীনের কোন বিষয় জানতে প্রশ্ন করেন। সেই ছাহাবীর প্রশ্নের চেয়ে কাফের সর্দারদের সাথে আলাপচারিতা রাসূলের কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়েছিল। কিন্তু আল্লাহর মানদন্ডে মু’মিনের দাবী অগ্রাধিকার পাবার যোগ্য। এ জন্য আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবীকে অনেক কথা শুনিয়ে নীচের আয়াতগুলো নাযিল করেন।

عَبَسَ وَتَوَلَّى * أَنْ جَاءَهُ الْأَعْمَى * وَمَا يُدْرِيكَ لَعَلَّهُ يَزَّكَّى * أَوْ يَذَّكَّرُ فَتَنْفَعَهُ الذِّكْرَى * أَمَّا مَنِ اسْتَغْنَى * فَأَنْتَ لَهُ تَصَدَّى * وَمَا عَلَيْكَ أَلَّا يَزَّكَّى * وَأَمَّا مَنْ جَاءَكَ يَسْعَى * وَهُوَ يَخْشَى * فَأَنْتَ عَنْهُ تَلَهَّى * كَلَّا إِنَّهَا تَذْكِرَةٌ * فَمَنْ شَاءَ ذَكَرَهُ

সে ভ্রূকুঞ্চিত করল এবং মুখ ফিরিয়ে নিল। কারণ, তাঁর কাছে এক অন্ধ আগমন করল। তুমি কি জান, সে হয়তো পরিশুদ্ধ হত, অথবা উপদেশ গ্রহণ করতো এবং উপদেশ তার উপকার হত। পরন্তু যে বেপরোয়া, তুমি তার চিন্তায় মশগুল। সে শুদ্ধ না হলে তোমার কোন দোষ নেই। যে তোমার কাছে দৌড়ে আসলো এমতাবস্থায় যে, সে ভয় করে, তুমি তাকে অবজ্ঞা করল। কখনও এরূপ করবে না, এটা উপদেশবানী। অতএব, যে ইচ্ছা করবে, সে একে গ্রহণ করবে। -৮০:১-১২

৪. মধু পান না করার প্রতিজ্ঞা

কোন এক ঘটনার প্রেক্ষাপটে নবীজি হালাল মধুকে নিজের জন্য হারাম ঘোষণা করেছিলেন; যদিও তা আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ বা হারাম ঘোষিত হয় নি। কাজেই আল্লাহ তাঁর রাসূলের এই নিষিদ্ধকরণের কাজকে অনুমোদন দেন নি। বরঞ্চ তাঁকে হুশিয়ার করেছেন।

يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ لِمَ تُحَرِّمُ مَا أَحَلَّ اللَّهُ لَكَ تَبْتَغِي مَرْضَاةَ أَزْوَاجِكَ

হে নবী, আল্লাহ তোমার জন্যে যা হালাল করছেন, তুমি তোমার স্ত্রীদেরকে খুশী করার জন্যে তা নিজের জন্যে হারাম করছো কেন? আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়াময়। -৬৬:১

বহু বর্ণিল মধু আল্লাহ প্রদত্ত একটি খুবই উপকারী প্রাকৃতিক পানীয় যার মধ্যে মানবজাতির বহু রোগমুক্তি রয়েছে বলে কুরআনে ঘোষণা আছে।

ثُمَّ كُلِي مِنْ كُلِّ الثَّمَرَاتِ فَاسْلُكِي سُبُلَ رَبِّكِ ذُلُلًا يَخْرُجُ مِنْ بُطُونِهَا شَرَابٌ مُخْتَلِفٌ أَلْوَانُهُ فِيهِ شِفَاءٌ لِلنَّاسِ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَةً لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ

(মৌমাছির উদ্দেশ্যে আল্লাহ বলেন) এরপর সর্বপ্রকার ফল থেকে ভক্ষণ কর এবং আপন পালনকর্তার উম্মুক্ত পথ সমূহে চলমান হও। তার পেট থেকে বিভিন্ন রঙের পানীয় নির্গত হয়। তাতে মানুষের জন্যে রয়েছে রোগের প্রতিকার। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্যে নিদর্শন রয়েছে। -১৬:৬৯

মধুর বহুমাত্রিক বাস্তব ব্যবহার রয়েছে। মধু আহরণকারী মৌমাছি নিয়ে মহিমান্বিত কুরআনে একটি সূরাই আছে- সূরা আন-নাহল (১৬)।

যদি নবী কর্তৃক মধু নিষিদ্ধ হবার পর আল্লাহ তা সংশোধন করে না দিতেন, তাহলে মুসলিম উম্মাহর জন্যও মধু নিষিদ্ধই থাকত। যে খাদ্য কোন কারণে রাসূল নিজে ভক্ষণ করেন নাই, তা গ্রহণ করা আল্লাহ-রাসূলের অবাধ্যতা বা বিরুদ্ধাচরণরূপেই গণ্য হত। উম্মাহর কোটি কোটি সদস্য প্রাকৃতিক এই সূধা- মধুর বহুমুখী উপকারিতা লাভ থেকে বঞ্চিত হত। আবার বহু মুসলিম এই উপকারিত বা এর স্বাদ গ্রহণের জন্য ‘মধু নিষিদ্ধ’-এর নিয়মও গোপনে বা প্রকাশ্যে লংঘন করত।

৫. নবী কর্তৃক একজন নিরপরাধ ইহুদীকে দোষী সাব্যস্ত করা ও রায় প্রদান করা।

নবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ ভুলক্রমে একজন মুসলমানের অপরাধের দায় একজন ইহুদীকে দিয়ে তাকে শাস্তির রায় প্রদান করেছিলেন বা প্রদানে উদ্যত হয়েছিলেন। আর সেই কাজে তাঁকে মিথ্যা সাক্ষ্য-প্রমান দিয়ে প্ররোচিত করেছিল মূল অপরাধির কতিপয় সহযোগী মুসলিম। এটা এত বড় একটি গর্হিত এবং অন্যায় রায় ছিল যে, আল্লাহ তা মোটেই সহ্য করতে পারেন নি এবং আরশ থেকে রায় প্রদান করে নিরপরাধ ইহুদীকে মুক্ত করেন এবং নবীকে সংশোধন করেন। একজন নিষ্পাপ মানুষকে আর একজনের অপরাধের কারণে স্বয়ং নবী কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত করা কাউকে হত্যা করে ফেলার চেয়ে কম কিছু নয় যা আল্লাহ দীর্ঘস্থায়ী হতে দেন নি।

إِنَّا أَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِتَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ بِمَا أَرَاكَ اللَّهُ وَلَا تَكُنْ لِلْخَائِنِينَ خَصِيمًا * وَاسْتَغْفِرِ اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ غَفُورًا رَحِيمًا * وَلَا تُجَادِلْ عَنِ الَّذِينَ يَخْتَانُونَ أَنْفُسَهُمْ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ مَنْ كَانَ خَوَّانًا أَثِيمًا * يَسْتَخْفُونَ مِنَ النَّاسِ وَلَا يَسْتَخْفُونَ مِنَ اللَّهِ وَهُوَ مَعَهُمْ إِذْ يُبَيِّتُونَ مَا لَا يَرْضَى مِنَ الْقَوْلِ وَكَانَ اللَّهُ بِمَا يَعْمَلُونَ مُحِيطًا * هَا أَنْتُمْ هَؤُلَاءِ جَادَلْتُمْ عَنْهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا فَمَنْ يُجَادِلُ اللَّهَ عَنْهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَمْ مَنْ يَكُونُ عَلَيْهِمْ وَكِيلًا * وَمَنْ يَعْمَلْ سُوءًا أَوْ يَظْلِمْ نَفْسَهُ ثُمَّ يَسْتَغْفِرِ اللَّهَ يَجِدِ اللَّهَ غَفُورًا رَحِيمًا * وَمَنْ يَكْسِبْ إِثْمًا فَإِنَّمَا يَكْسِبُهُ عَلَى نَفْسِهِ وَكَانَ اللَّهُ عَلِيمًا حَكِيمًا * وَمَنْ يَكْسِبْ خَطِيئَةً أَوْ إِثْمًا ثُمَّ يَرْمِ بِهِ بَرِيئًا فَقَدِ احْتَمَلَ بُهْتَانًا وَإِثْمًا مُبِينًا * وَلَوْلَا فَضْلُ اللَّهِ عَلَيْكَ وَرَحْمَتُهُ لَهَمَّتْ طَائِفَةٌ مِنْهُمْ أَنْ يُضِلُّوكَ وَمَا يُضِلُّونَ إِلَّا أَنْفُسَهُمْ وَمَا يَضُرُّونَكَ مِنْ شَيْءٍ وَأَنْزَلَ اللَّهُ عَلَيْكَ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَعَلَّمَكَ مَا لَمْ تَكُنْ تَعْلَمُ وَكَانَ فَضْلُ اللَّهِ عَلَيْكَ عَظِيمًا

নিশ্চয় আমি তোমার প্রতি সত্য কিতাব অবতীর্ণ করেছি, যাতে তুমি মানুষের মধ্যে ফয়সালা কর, যা আল্লাহ তোমাকে হৃদয়ঙ্গম করান। তুমি বিশ্বাসঘাতকদের পক্ষ থেকে বিতর্ককারী হয়ো না। এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু। যারা মনে বিশ্বাসঘাতকতা পোষণ করে তাদের পক্ষ থেকে বিতর্ক করবে না। আল্লাহ পছন্দ করেন না তাকে, যে বিশ্বাসঘাতক পাপী হয়। তারা মানুষের কাছে লজ্জিত হয় এবং আল্লাহর কাছে লজ্জিত হয় না। তিনি তাদের সাথে রয়েছেন, যখন তারা রাত্রে এমন বিষয়ে পরামর্শ করে, যাতে আল্লাহ সম্মত নন। তারা যা কিছু করে, সবই আল্লাহর আয়ত্তাধীণ। শুনছ? তোমরা তাদের পক্ষ থেকে পার্থিব জীবনে বিবাদ করছ, অতঃপর কেয়ামতের দিনে তাদের পক্ষ হয়ে আল্লাহর সাথে কে বিবাদ করবে অথবা কে তাদের কার্যনির্বাহী হবে। যে গোনাহ, করে কিংবা নিজের অনিষ্ট করে, অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, সে আল্লাহকে ক্ষমাশীল, করুণাময় পায়। যে কেউ পাপ করে, সে নিজের পক্ষেই করে। আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়। যে ব্যক্তি ভূল কিংবা গোনাহ করে, অতঃপর কোন নিরপরাধের উপর অপবাদ আরোপ করে সে নিজের মাথায় বহন করে জঘন্য মিথ্যা ও প্রকাশ্য গোনাহ। যদি তোমার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণা না হত, তবে তাদের একদল তোমাকে পথভ্রষ্ট করার সংকল্প করেই ফেলেছিল। তারা পথভ্রান্ত করতে পারে না কিন্তু নিজেদেরকেই এবং তোমার কোন অনিষ্ট করতে পারে না। আল্লাহ তোমার প্রতি ঐশীগ্রন্থ ও প্রজ্ঞা অবতীর্ণ করেছেন এবং তোমাকে এমন বিষয় শিক্ষা দিয়েছেন, যা তুমি জানতে না। তোমার প্রতি আল্লাহর করুণা অসীম। -৪:১০৫-১১৩

৬. দ্বিগুন শাস্তির হুমকি

কুরআনে দু’টি প্রেক্ষাপটে নবী মুহাম্মদকে (তাঁর উপর শান্তি) সতর্ক করা হয়েছে যে, যদি আল্লাহ তাঁকে মজবুত ও দৃঢ়পদ না রাখতেন, তবে কিছু মানুষ তাকে বিপথগামী করেই ছাড়ত।

وَإِنْ كَادُوا لَيَفْتِنُونَكَ عَنِ الَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ لِتَفْتَرِيَ عَلَيْنَا غَيْرَهُ وَإِذًا لَاتَّخَذُوكَ خَلِيلًا * وَلَوْلَا أَنْ ثَبَّتْنَاكَ لَقَدْ كِدْتَ تَرْكَنُ إِلَيْهِمْ شَيْئًا قَلِيلًا * إِذًا لَأَذَقْنَاكَ ضِعْفَ الْحَيَاةِ وَضِعْفَ الْمَمَاتِ ثُمَّ لَا تَجِدُ لَكَ عَلَيْنَا نَصِيرًا

তারা তো তোমাকে হটিয়ে দিতে চাচ্ছিল যে বিষয় আমি তোমার প্রতি ওহীর মাধ্যমে যা প্রেরণ করেছি তা থেকে তোমার পদঙ্খলন ঘটানোর জন্যে তারা চুড়ান্ত চেষ্টা করেছে, যাতে তুমি আমার প্রতি কিছু মিথ্যা সম্বন্ধযুক্ত করো। এতে সফল হলে তারা তোমাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে নিত। আমি তোমাকে দৃঢ়পদ না রাখলে তুমি তাদের প্রতি কিছুটা ঝুঁকেই পড়তে। তখন আমি অবশ্যই তোমাকে ইহজীবনে ও পরজীবনে দ্বিগুণ শাস্তির আস্বাদন করাতাম। এ সময় তুমি আমার মোকাবিলায় কোন সাহায্যকারী পেতে না। -১৭:৭৩-৭৫

এখানে দ্ব্যর্থহীনভাবে আল্লাহ তাঁর শেষনবীকে দ্বিগুণ শাস্তির হুমকি শুনিয়ে দিচ্ছেন যদি রাসূল ষড়যন্ত্রকারীদের ছলনায় ঝুঁকে পড়তেন- আল্লাহই তাঁকে বিশেষ অনুগ্রহে রক্ষা করেছেন সেই কঠিন শাস্তি থেকে।

দ্বিগুণ শাস্তির সম্ভাবনা এবং সে সংক্রান্ত হুমকি থেকে আল্লাহ শেষনবীর স্ত্রীগণকেও রেহাই দেননি।

يَا نِسَاءَ النَّبِيِّ مَنْ يَأْتِ مِنْكُنَّ بِفَاحِشَةٍ مُبَيِّنَةٍ يُضَاعَفْ لَهَا الْعَذَابُ ضِعْفَيْنِ وَكَانَ ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرًا

হে নবী পত্নীগণ! তোমাদের মধ্যে কেউ প্রকাশ্য অশ্লীল কাজ করলে তাকে দ্বিগুণ শাস্তি দেয়া হবে। এটা আল্লাহর জন্য সহজ। -৩৩:৩০

إِنْ تَتُوبَا إِلَى اللَّهِ فَقَدْ صَغَتْ قُلُوبُكُمَا وَإِنْ تَظَاهَرَا عَلَيْهِ فَإِنَّ اللَّهَ هُوَ مَوْلَاهُ وَجِبْرِيلُ وَصَالِحُ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمَلَائِكَةُ بَعْدَ ذَلِكَ ظَهِيرٌ

তোমাদের অন্তর অন্যায়ের দিকে ঝুঁকে পড়েছে বলে যদি তোমরা উভয়ে তওবা কর, তবে ভালকথা। আর যদি নবীর বিরুদ্ধে একে অপরকে সাহায্য কর, তবে জেনে রেখ আল্লাহ জিবরাঈল এবং সৎকর্মপরায়ণ মুমিনগণ তাঁর সহায়। উপরন্তু ফেরেশতাগণও তাঁর সাহায্যকারী। -৬৬:৪

৭. তুমি তোমার পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো

কোন মু’মিন-মুসলিমই একথা বলতে পারে না যে, এ জাতীয় আয়াতের আলোচনার মাধ্যমে শেষনবীকে হেয় বা ছোট করার অপপ্রয়াস চালানো হচ্ছে। যদি তাই হত, তবে আল্লাহ নিজেই সেই আলোচনা কুরআনে করতেন না। এগুলো কোন গোপন আয়াতসমষ্টি নয়; বরং তা পুরো মানবজাতির জন্য বিস্তৃত পাঠ, পরীক্ষা-নিরিক্ষা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে।

বেশ কিছু আয়াতে আল্লাহ শেষনবীকে তাঁর পাপের কারণে ক্ষমা চাইতে নির্দেশ দিয়েছেন।

فَاصْبِرْ إِنَّ وَعْدَ اللَّهِ حَقٌّ وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ

অতএব, তুমি সবর করো নিশ্চয় আল্লাহর ওয়াদা সত্য। তুমি তোমার গোনাহের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করো। -৪০:৫৫

فَاعْلَمْ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ

জেনে রাখ, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। ক্ষমা প্রার্থনা করো, তোমার পাপের জন্যে। -৪৭:১৯

لِيَغْفِرَ لَكَ اللَّهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ

যাতে আল্লাহ তোমার অতীত ও ভবিষ্যত পাপসমূহ মার্জনা করে দেন। -৪৮:১-২

তুমি বিশ্বাসঘাতকদের পক্ষ থেকে বিতর্ককারী হয়ো না। এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। -৪:১০৫-১০৬

কুরআনে তিনবার ‘জামবিকা’ ব্যবহৃত হয়েছে যার অর্থ ‘তোমার পাপ বা গুনাহ’। এর বাইরে বহু বহু বার নবীকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তদুপরি, সূরা হাক্কায় আল্লাহ তা’য়ালা ‘যদি’-যোগে (وَلَوْ) বলেন, যদি নবী কর্তৃক এই কুরআনে কোন কিছু তিনি আল্লাহর নামে মনগড়া আরোপ করতেন তবে তাঁর জন্য নেমে আসত ভয়াবহ পরিণতি।

إِنَّهُ لَقَوْلُ رَسُولٍ كَرِيمٍ * وَمَا هُوَ بِقَوْلِ شَاعِرٍ قَلِيلًا مَا تُؤْمِنُونَ * وَلَا بِقَوْلِ كَاهِنٍ قَلِيلًا مَا تَذَكَّرُونَ * تَنْزِيلٌ مِنْ رَبِّ الْعَالَمِينَ * وَلَوْ تَقَوَّلَ عَلَيْنَا بَعْضَ الْأَقَاوِيلِ * لَأَخَذْنَا مِنْهُ بِالْيَمِينِ * ثُمَّ لَقَطَعْنَا مِنْهُ الْوَتِينَ * فَمَا مِنْكُمْ مِنْ أَحَدٍ عَنْهُ حَاجِزِينَ

নিশ্চয়ই এই কোরআন একজন সম্মানিত রাসূলের আনীত। এবং এটা কোন কবির কালাম নয়; তোমরা কমই বিশ্বাস কর। এবং এটা কোন অতীন্দ্রিয়বাদীর কথা নয়; তোমরা কমই অনুধাবন কর। এটা বিশ্বপালনকর্তার কাছ থেকে অবতীর্ণ। সে যদি আমার নামে কোন কথা রচনা করত, তবে আমি তার দক্ষিণ হস্ত ধরে ফেলতাম, অতঃপর কেটে দিতাম তার গ্রীবা। তোমাদের কেউ তাকে রক্ষা করতে পারতে না।– ৬৯:৪০-৪৭

যদিও সূরা আত-তুরে আল্লাহ সত্যায়ন করেন যে, নবীজি নিজে থেকে এই কুরআন রচনা করেন নাই।

أَمْ يَقُولُونَ تَقَوَّلَهُ بَلْ لَا يُؤْمِنُونَ

না তারা বলেঃ এই কোরআন সে নিজে রচনা করেছে? বরং তারা অবিশ্বাসী। -৫২:৩৩

এখন যেসব কারণ উল্লেখ করে হযরত আদম, নূহ, ইবরাহীম, মূসা কিয়ামতের দিবসে সুপারিশ করতে তাদের অপারগতা প্রকাশ করবেন আল্লাহর ভয়ে, শেষনবীর ক্ষেত্রে আলোচিত সাতটি কারণ তারচেয়ে কি অনেক গুরুতর নয়? পূর্ববর্তী নবীগণ যদি কথিত সেই একটি ‘অপরাধের’ কারণে সাফায়াত করার সাহস না দেখান, তাহলে শেষনবী কীভাবে এত এত ‘অপরাধসমূহ (?)’ নিয়ে সেই সাহস প্রদর্শন করবেন?

মহান নবীগনের বিরুদ্ধে কল্পনাপ্রসূত অভিযোগ খন্ডন

এবার যাচাই করা যাক, উপরিউক্ত হাদীসে মহান নবীগণের বিরুদ্ধে যে কল্পিত অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে, সে ব্যাপারে কুরআন কী বলে।

হযরত আদম

যখন হযরত আদম (তাঁর উপর শান্তি) পৃথিবীতে পদার্পন করেন, তখন তিনি তাঁর কৃত ভুলের জন্য অনুতাপ-অনুশোচনা করেন; এবং আল্লাহ তাঁর ওয়াদা মাফিক তাঁর প্রতি তাঁর অনুগ্রহ বর্ষণ করেন। আল্লাহ তাঁকে নির্বাচিত করেন এবং সঠিক হেদায়েতের পথ প্রদর্শন করেন।

ثُمَّ اجْتَبَاهُ رَبُّهُ فَتَابَ عَلَيْهِ وَهَدَى

এরপর তার পালনকর্তা তাকে মনোনীত করলেন, তার প্রতি মনোযোগী হলেন এবং তাকে সুপথে আনয়ন করলেন। -২০:১২২

فَتَلَقَّى آَدَمُ مِنْ رَبِّهِ كَلِمَاتٍ فَتَابَ عَلَيْهِ إِنَّهُ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ

অতঃপর হযরত আদম (আঃ) স্বীয় পালনকর্তার কাছ থেকে কয়েকটি কথা শিখে নিলেন, অতঃপর আল্লাহ পাক তাঁর প্রতি (করুণাভরে) লক্ষ্য করলেন। নিশ্চয়ই তিনি মহা-ক্ষমাশীলও অসীম দয়ালু। -২:৩৭

এটা সম্পূর্ণ পরিষ্কার যে, হযরত আদম আল্লাহ কর্তৃক পৃথিবীতেই ক্ষমাকৃত এবং হেদায়েতপ্রাপ্ত ছিলেন- কুরআন তা একাধিক বিবৃতির মধ্য দিয়ে সত্যায়ন করে। সুতরাং, শেষনবীর নামে বাড়াবাড়ি আরোপ করতে গিয়ে আমরা প্রকারান্তরে মানবজাতির আদিপিতা হযরত আদমকে হেয় ও ছোট করে উপস্থাপন করবার ধৃষ্টতা দেখাচ্ছি – যা মোটেই সত্য নয়।

তারচেয়েও বড় কথা, মানব সৃষ্টির একেবারে প্রারম্ভে জান্নাতে ঘটিত আদমের ভুলের সাথে, পৃথিবীতে সংঘটিত নবীগণের কৃত ভুলকে এক পাল্লায় মাপা যায় না। পৃথিবীতে আগমনের পর আমাদের সবার আদিপিতার আর কোন ভুল বা পাপের উল্লেখ আমরা পুরো কুরআনে পাই না।

হযরত নূহ

একজন পিতা এবং নবী হিসেবে হযরত নূহ আল্লাহর কাছে নিজ সন্তানের জন্য ক্ষমা চান। সেজন্যে আল্লাহ তাঁকে সতর্ক করেন এই বলে যে, তাঁর সন্তান তাঁর পরিবারভুক্ত নয়, বরং একজন অসৎ মানুষ; এবং তাঁর উচিত নয় তার জন্য প্রার্থনা করা। হযরত নূহ তাৎক্ষণিকভাবে আল্লাহর কাছে নিজ অজ্ঞতার জন্য ক্ষমা ভিক্ষা চান এবং সেই বিষয় থেকে পানাহ চান যে বিষয়ে তাঁর জ্ঞান নেই। আল্লাহ নিজ নবীর প্রতি সদয় হন এবং তাঁর প্রতি তাঁর ‘শান্তি এবং কল্যান’ (বিসালামিম মিন্না ওয়া বারাকাত) বর্ষনের ঘোষণা জানিয়ে দেন।

وَنَادَى نُوحٌ رَبَّهُ فَقَالَ رَبِّ إِنَّ ابْنِي مِنْ أَهْلِي وَإِنَّ وَعْدَكَ الْحَقُّ وَأَنْتَ أَحْكَمُ الْحَاكِمِينَ * قَالَ يَا نُوحُ إِنَّهُ لَيْسَ مِنْ أَهْلِكَ إِنَّهُ عَمَلٌ غَيْرُ صَالِحٍ فَلَا تَسْأَلْنِ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنِّي أَعِظُكَ أَنْ تَكُونَ مِنَ الْجَاهِلِينَ * قَالَ رَبِّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ أَنْ أَسْأَلَكَ مَا لَيْسَ لِي بِهِ عِلْمٌ وَإِلَّا تَغْفِرْ لِي وَتَرْحَمْنِي أَكُنْ مِنَ الْخَاسِرِينَ * قِيلَ يَا نُوحُ اهْبِطْ بِسَلَامٍ مِنَّا وَبَرَكَاتٍ عَلَيْكَ وَعَلَى أُمَمٍ مِمَّنْ مَعَكَ

আর নূহ (আঃ) তাঁর পালনকর্তাকে ডেকে বললেন- হে পরওয়ারদেগার, আমার পুত্র তো আমার পরিজনদের অন্তর্ভুক্ত; আর আপনার ওয়াদাও নিঃসন্দেহে সত্য আর আপনিই সর্বাপেক্ষা বিজ্ঞ ফয়সালাকারী। আল্লাহ বলেন, হে নূহ! নিশ্চয় সে তোমার পরিবারভুক্ত নয়। নিশ্চই সে দুরাচার! সুতরাং আমার কাছে এমন দরখাস্ত করবে না, যার খবর তুমি জানো না। আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি যে, তুমি অজ্ঞদের দলভুক্ত হয়ো না। নূহ (আঃ) বলেন- হে আমার পালনকর্তা আমার যা জানা নেই এমন কোন দরখাস্ত করা হতে আমি আপনার কাছেই আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আপনি যদি আমাকে ক্ষমা না করেন, দয়া না করেন, তাহলে আমি ক্ষতিগ্রস্ত হব। বলা হল- হে নূহ! অবতরণ কর আমাদের থেকে শান্তির সাথে, আর তোমার উপরে ও তোমার সাথে যারা রয়েছে তাদের সম্প্রদায়ের উপরে আশীর্বাদ নিয়ে। -১১:৪৫-৪৮

হযরত নূহ সম্পর্কে আল্লাহ আরও যা কিছু অতিরিক্ত বলেছেন, তা হল তিনি ছিলেন মুখলিছিন (الْمُخْلَصِينَ)

وَلَقَدْ نَادَانَا نُوحٌ فَلَنِعْمَ الْمُجِيبُونَ * وَنَجَّيْنَاهُ وَأَهْلَهُ مِنَ الْكَرْبِ الْعَظِيمِ * وَجَعَلْنَا ذُرِّيَّتَهُ هُمُ الْبَاقِينَ * وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الْآَخِرِينَ * سَلَامٌ عَلَى نُوحٍ فِي الْعَالَمِينَ * إِنَّا كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ * إِنَّهُ مِنْ عِبَادِنَا الْمُؤْمِنِينَ

আর নূহ আমাকে ডেকেছিল। আর কি চমৎকারভাবে আমি তার ডাকে সাড়া দিয়েছিলাম। আমি তাকে ও তার পরিবারবর্গকে এক মহাসংকট থেকে রক্ষা করেছিলাম। এবং তার বংশধরদেরকেই আমি অবশিষ্ট রেখেছিলাম। আমি তার জন্যে পরবর্তীদের মধ্যে এ বিষয় রেখে দিয়েছি যে, বিশ্ববাসীর মধ্যে নূহের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। আমি এভাবেই সৎকর্ম পরায়নদেরকে পুরস্কৃত করে থাকি। সে ছিল আমার ঈমানদার বান্দাদের অন্যতম। -৩৭:৭৫-৮১

وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا نُوحًا وَإِبْرَاهِيمَ وَجَعَلْنَا فِي ذُرِّيَّتِهِمَا النُّبُوَّةَ وَالْكِتَابَ

আমি নূহ ও ইব্রাহীমকে রসূলরূপে প্রেরণ করেছি এবং তাদের বংশধরের মধ্যে নবুওয়ত ও কিতাব অব্যাহত রেখেছি। অতঃপর তাদের কতক সৎপথপ্রাপ্ত হয়েছে এবং অধিকাংশই হয়েছে পাপাচারী। -৫৭:২৬

سَلَامٌ عَلَى نُوحٍ فِي الْعَالَمِينَ

বিশ্ববাসীর মধ্যে নূহের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। -৩৭:৭৯

হযরত ইবরাহীম

হযরত ইবরাহীম কুরআনুল কারীমে চিত্রিত নবীগণের মধ্যে সবচেয়ে অধিক সম্মানিত, অনুসরণীয় এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় নবী। যাকে আল্লাহ ‘সিদ্দীকান নাবিয়্যা’ বা অতি সত্যবাদী নবী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّهُ كَانَ صِدِّيقًا نَبِيًّا

(হে মুহাম্মদ) তুমি এই কিতাবে ইব্রাহীমের কথা বর্ণনা করো। নিশ্চয় তিনি ছিলেন সত্যবাদী, নবী। -১৯:৪১

আমাদের মত হতভাগা আর কে হতে পারে, আল্লাহ নিজে যার নবীকে সত্যবাদী নবী হিসেবে আমাদের সামনে উপস্থাপিত করলেন, আমরা আমাদের হঠকারিতা আর দূর্বৃত্তপনা দ্বারা তাঁকেই হাজির করলাম ‘মিথ্যাবাদী’ হিসেবে।

أُولَئِكَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ مِنْ ذُرِّيَّةِ آَدَمَ وَمِمَّنْ حَمَلْنَا مَعَ نُوحٍ وَمِنْ ذُرِّيَّةِ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْرَائِيلَ وَمِمَّنْ هَدَيْنَا وَاجْتَبَيْنَا إِذَا تُتْلَى عَلَيْهِمْ آَيَاتُ الرَّحْمَنِ خَرُّوا سُجَّدًا وَبُكِيًّا

এরাই তারা- নবীগণের মধ্য থেকে যাদেরকে আল্লাহ তা’আলা নেয়ামত দান করেছেন। এরা আদমের বংশধর এবং যাদেরকে আমি নূহের সাথে নৌকায় আরোহন করিয়েছিলাম, তাদের বংশধর, এবং ইব্রাহীম ও ইসরাঈলের বংশধর এবং যাদেরকে আমি পথ প্রদর্শন করেছি ও মনোনীত করেছি, তাদের বংশোদ্ভূত। তাদের কাছে যখন দয়াময় আল্লাহর আয়াতসমূহ পাঠ করা হত, তখন তারা সেজদায় লুটিয়ে পড়ত এবং ক্রন্দন করত। -১৯:৫৮

إِنَّ إِبْرَاهِيمَ لَحَلِيمٌ أَوَّاهٌ مُنِيبٌ

নিঃসন্দেহ ইবরাহীম তো ছিলেন সহনশীল, কোমল হৃদয়, সতত প্রত্যাবর্তনকারী। -১১:৭৫

وَمَا كَانَ اسْتِغْفَارُ إِبْرَاهِيمَ لِأَبِيهِ إِلَّا عَنْ مَوْعِدَةٍ وَعَدَهَا إِيَّاهُ فَلَمَّا تَبَيَّنَ لَهُ أَنَّهُ عَدُوٌّ لِلَّهِ تَبَرَّأَ مِنْهُ إِنَّ إِبْرَاهِيمَ لَأَوَّاهٌ حَلِيمٌ

আর ইব্রাহীম কর্তৃক স্বীয় পিতার মাগফেরাত কামনা ছিল কেবল সেই প্রতিশ্রুতির কারণে, যা তিনি তার সাথে করেছিলেন। অতঃপর যখন তাঁর কাছে একথা প্রকাশ পেল যে, সে আল্লাহর শত্রু তখন তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে নিলেন। নিঃসন্দেহে ইব্রাহীম ছিলেন বড় কোমল হৃদয়, সহনশীল। -৯:১১৪

وَلَقَدْ آَتَيْنَا إِبْرَاهِيمَ رُشْدَهُ مِنْ قَبْلُ وَكُنَّا بِهِ عَالِمِينَ

আর, আমি ইতিপূর্বে ইবরাহীমকে তার সৎপন্থা দান করেছিলাম এবং আমি তার সম্পর্কে সম্যক পরিজ্ঞাত ও ছিলাম। -২১:৫১

ইবরাহীমের বিরুদ্ধে ‘মিথ্যাচারিতার’ অভিযোগ

قَالُوا أَأَنْتَ فَعَلْتَ هَذَا بِآَلِهَتِنَا يَا إِبْرَاهِيمُ * قَالَ بَلْ فَعَلَهُ كَبِيرُهُمْ هَذَا فَاسْأَلُوهُمْ إِنْ كَانُوا يَنْطِقُونَ

তারা বললঃ হে ইবরাহীম তুমিই কি আমাদের উপাস্যদের সাথে এরূপ ব্যবহার করেছ? তিনি বললেনঃ বরং এদের এই প্রধানই তো একাজ করেছে। অতএব তাদেরকে জিজ্ঞেস কর, যদি তারা কথা বলতে পারে। -২১:৬২-৬৩

কথিত ‘আলেম-উলামা’ সম্প্রদায় সমাজে একটা অত্যন্ত গর্হিত এবং সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা চালু করেছে যে, হযরত ইবরাহীম নবী জীবন লাভের পরও ‘মিথ্যা’ বলেছিলেন – যা এই মহান নবীর প্রতি একেবারেই ডাহা মিথ্যাচার। যেখানে মুসলিম সমাজ হযরত ইবরাহীমকে ‘মিথ্যাবাদী’ প্রতিপন্ন করতে উঠেপড়ে লাগে; তখন আল্লাহ তাঁর প্রিয়তম নবীকে ‘সিদ্দীকান নাবিয়্যা’, অর্থাৎ সবচেয়ে সত্যবাদী নবী হিসেবে সত্যায়ন করেন।

মিথ্যা এমন কিছু যা দ্বারা কেউ কোন বিষয়ে তার সম্পৃক্ততা লুকাতে চায়। এখানে, নবী ইবরাহীমের অভিপ্রায় মোটেই তা ছিল না; বরং তিনি বাক্য বিন্যাসে এমন একটি পদ্ধতি প্রয়োগ করেছিলেন যা দ্বারা তিনি তাদের বিবেককে নাড়া দিতে চেয়েছিলেন যাতে তারা উপলব্ধি করতে পারে। সেই মূর্তিপূজকেরাও এটা বিশ্বাস করত না যে, তাদের সবচেয়ে বড় দেবতা এই কর্ম করেছে যেহেতু সেটা করবার কোন ক্ষমতা তার নেই; তারা এটা ভাল করেই বোঝে যে এ জাতীয় কিছু তারা করতে পারে না।

হযরত ইবরাহীমের আল্লাহ প্রদত্ত এই বুদ্ধিমত্তায় যথেষ্ট কাজ হয়; তাঁর এই প্রশ্নে তাদের মাথা হেট হয়ে গেল।

ثُمَّ نُكِسُوا عَلَى رُءُوسِهِمْ لَقَدْ عَلِمْتَ مَا هَؤُلَاءِ يَنْطِقُونَ

অতঃপর উহাদের মস্তক অবনত হইয়া গেল এবং উহারা বলিল, ‘তুমি তো জানই যে, ইহারা কথা বলে না’। -২১:৬৫

নিজ হাতে দেবতাদেরকে ভেঙ্গে ফেলা সংক্রান্ত তথ্য গোপন করবার কোন ইচ্ছাই নবী ইবরাহীমের ছিল না যা একটু পরেই স্পষ্ট হয়ে যাবে; আর এর দ্বারা তারা লজ্জিত হবে।

প্রথমত, মূর্তিপূজকদের প্রশ্নের জবাবে ইবরাহীম একথা বলেন নাই যে, তিনি তা ভাঙ্গেন নি। বরং অতি অল্প সময়ের জন্য একটি যুক্তি-কৌশল (হুজ্জাত)-এর অবলম্বন করেছেন তাদের অবচেতন মনে আঘাত করে ভুল ভেঙ্গে দেবার জন্য।

যখন ইবরাহীমের বুদ্ধিমত্তার কাছে তারা হেরে গেল, তখন তিনি তাদের চূড়ান্ত আঘাত হানেন আর প্রকারান্তরে সেই আঘাতের মধ্য দিয়েই স্বীকার করে নেন যে, তিনিই ভাঙ্গার কাজটি করেছেন।

قَالَ أَفَتَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَنْفَعُكُمْ شَيْئًا وَلَا يَضُرُّكُمْ

ইবরাহীম বলিল, ‘তবে কি তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর ইবাদত কর যাহা তোমাদের কোন উপকার করিতে পারে না, ক্ষতিও করিতে পারে না”। -২১:৬৬

একটি দৃষ্টান্ত কল্পনা করা যাক।

কোন এক অফিসের বস তার অধিনস্ত পাঁচ কর্মীকে একটি কাজ সম্পন্ন করবার জন্য খুব তাগিদ দিলেন। একদিন, দু’দিন, তিনদিন পার হয়ে গেল; কেউ তা করল না। চতুর্থ দিন সবার অফিসে আগমনের পূর্বে বস নিজেই কাজটি সম্পন্ন করে অফিসে রেখে দিলেন।

নির্দিষ্ট পাঁচ কর্মী অফিসে এসে কাজটি দেখে একে অপরকে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হল, তাদের কেউ তা করে নি এবং তারা এটাও বুঝে গেল, কাজটি জরুরী ছিল বিধায় বস নিজেই তা নিষ্পন্ন করেছেন।

অতঃপর যখন বসের সঙ্গে তাদের দেখা হল, তাদের একজন বসকে বিনয়ের সাথে এবং অপরাধি মনে জানতে চাইল, তিনিই কাজটি করেছেন কিনা?

বস তখন সরাসরি অস্বীকার না করে কৌশলে উত্তর দিলেন, কাজটি তো তোমাদেরই করবার কথা, তোমাদের কেউই হয়ত করেছে।

যেহেতু, তারা ইতিমধ্যেই নিশ্চিত হয়েছে, তাদের কেউ তা করেনি, তাই বসের এই উত্তরে তারা প্রত্যেকেই যথেষ্ট লজ্জিত বোধ করবে।

আমাদের পারিবারিক, প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক জীবনে এ জাতীয় ঘটনা অনেক সময় ঘটে থাকে – যা আমরা অন্যকে কিছু উপলব্ধি করাতে, শিখাতে প্রয়োগ করে থাকি।

এই ঘটনা থেকে আমরা কেউ একথা বলব না যে, ঘটনার বস তার কর্মীদের কাছে ‘মিথ্যা’ কথা বলেছেন।

কোন বিষয়ে প্রাসঙ্গিক সকল আয়াত যাচাই-বাছাই ব্যতিরেকেই, মুসলিম সম্প্রদায় আমভাবে হযরত ইবরাহীমের উপর একটি ভয়াবহ কলঙ্ক আরোপ করে চলেছে যে, তিনি ‘মিথ্যা’ বলেছিলেন যা একেবারেই সত্য নয়। বরঞ্চ, এই প্রজ্ঞা আল্লাহ তাঁকে দান করেছিলেন যেমনটি কুরআনে বলা হয়েছে।

وَتِلْكَ حُجَّتُنَا آَتَيْنَاهَا إِبْرَاهِيمَ عَلَى قَوْمِهِ نَرْفَعُ دَرَجَاتٍ مَنْ نَشَاءُ إِنَّ رَبَّكَ حَكِيمٌ عَلِيمٌ

আর ইহা আমাদের যুক্তি-প্রমাণ যাহা ইবরাহীমকে দিয়াছিলাম তাহার সম্প্রদায়কে মুকাবিলায়; যাহাকে ইচ্ছা মর্যাদায় আমরা উন্নীত করি। নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞ। -৬:৮৩

আরও বলা হয়েছে।

وَلَقَدْ آَتَيْنَا إِبْرَاهِيمَ رُشْدَهُ مِنْ قَبْلُ

আমরা তো ইহার পূর্বে ইবরাহীমকে সৎপথের জ্ঞান দিয়াছিলাম। -২১:৫১

আল্লাহ তা’য়ালা ইবরাহীমের ব্যাপারে তাঁর পক্ষ থেকে ‘সালাম’ বর্ষণের ঘোষণাও দিয়েছেন।

سَلَامٌ عَلَى إِبْرَاهِيمَ

ইবরাহীমের উপর সালাম। -৩৭:১০৯

হযরত মূসা

হযরত মূসা একজন ঝগড়াটে মিশরীয়কে অনিচ্ছাকৃতভাবে মেরে ফেলেছিলেন, আর সেজন্যে তিনি তাঁর জীবিতাবস্থায় যথেষ্ট অনুতপ্ত ছিলেন। আল্লাহ নবীর এই আক্ষেপ-অনুশোচনার বিষয়টিকে উদ্দেশ্য করে মহান নবীকে শান্তনা দিয়েছেন।

وَقَتَلْتَ نَفْسًا فَنَجَّيْنَاكَ مِنَ الْغَمِّ وَفَتَنَّاكَ فُتُونًا فَلَبِثْتَ سِنِينَ فِي أَهْلِ مَدْيَنَ ثُمَّ جِئْتَ عَلَى قَدَرٍ يَا مُوسَى

তুমি এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলে, অতঃপর আমি তোমাকে এই দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দেই; আমি তোমাকে অনেক পরীক্ষা করেছি। অতঃপর তুমি কয়েক বছর মাদইয়ান বাসীদের মধ্যে অবস্থান করেছিলে; হে মূসা, অতঃপর তুমি নির্ধারিত সময়ে এসেছ। -২০:৪০

وَدَخَلَ الْمَدِينَةَ عَلَى حِينِ غَفْلَةٍ مِنْ أَهْلِهَا فَوَجَدَ فِيهَا رَجُلَيْنِ يَقْتَتِلَانِ هَذَا مِنْ شِيعَتِهِ وَهَذَا مِنْ عَدُوِّهِ فَاسْتَغَاثَهُ الَّذِي مِنْ شِيعَتِهِ عَلَى الَّذِي مِنْ عَدُوِّهِ فَوَكَزَهُ مُوسَى فَقَضَى عَلَيْهِ قَالَ هَذَا مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ عَدُوٌّ مُضِلٌّ مُبِينٌ * قَالَ رَبِّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي فَاغْفِرْ لِي فَغَفَرَ لَهُ إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ

সে (মূসা) শহরে প্রবেশ করল, যখন তার অধিবাসীরা ছিল বেখবর। তথায় তিনি দুই ব্যক্তিকে লড়াইরত দেখল। এদের একজন ছিল তাঁর নিজ দলের এবং অন্য জন তাঁর শত্রু দলের। অতঃপর যে তাঁর নিজ দলের সে তাঁর শত্রু দলের লোকটির বিরুদ্ধে তাঁর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করল। তখন মূসা তাকে ঘুষি মারল এবং এতেই তার মৃত্যু হয়ে গেল। মূসা বলল, এটা শয়তানের কাজ। নিশ্চয় সে প্রকাশ্য শত্রু, বিভ্রান্তকারী। সে বলল, হে আমার পালনকর্তা, আমি তো নিজের উপর জুলুম করে ফেলেছি। অতএব, আমাকে ক্ষমা করুন। আল্লাহ তাকে ক্ষমা করলেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, দয়ালু। -২৮:১৫-১৬

কুরআনে আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষণা, সুনির্দিষ্ট সেই ঘটনার প্রেক্ষাপটে মূসা নবীর অনুতাপ-আক্ষেপের বদৌলতে আল্লাহ তাঁকে ক্ষমার ঘোষণা দিয়েছেন। হযরত নূহ এবং ইবরাহীমের মত, আল্লাহ তাঁর বিষয়েও ঘোষণা করেন।

سَلَامٌ عَلَى مُوسَى وَهَارُونَ

মূসা এবং হারুনের প্রতি সালাম। – ৩৭:১২০

হযরত ঈসা

শাফায়াতের দায়িত্ব গ্রহণ না করার ব্যাপারে হাদীসের বর্ণনায় হযরত ঈসা কোন কারণের কথা বলবেন না; শুধু ‘ইয়া নাফসি’, ‘ইয়া নাফসি’ করতে থাকবেন। কোন কারণ ছাড়াই তিনি কিয়ামতবাসীকে ফিরিয়ে দিবেন।

“নিঃসন্দেহ ঈসার দৃষ্টান্ত হচ্ছে আল্লাহ্‌র কাছে আদমের দৃষ্টান্তের মতো। তিনি তাঁকে সৃষ্টি করেছিলেন মাটি থেকে; তারপর তাঁকে বলেছিলেন- ‘হও’ আর তিনি হয়ে গেলেন”। -৩:৫৯

বহু নবী-রাসূলগণের উপর হযরত মূসা-ঈসার মর্যাদার প্রাধান্য বলতে গিয়ে আল্লাহ বলেন-

تِلْكَ الرُّسُلُ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ مِنْهُمْ مَنْ كَلَّمَ اللَّهُ وَرَفَعَ بَعْضَهُمْ دَرَجَاتٍ وَآَتَيْنَا عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ الْبَيِّنَاتِ وَأَيَّدْنَاهُ بِرُوحِ الْقُدُسِ

এইসব রাসূল- তাঁদের কাউকে আমরা অপর কারোর উপরে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি। তাঁদের মধ্যে কারোর সাথে আল্লাহ কথা বলেছেন এবং তাঁদের কাউকে তিনি বহুস্তর উন্নত করেছেন। আর আমরা মরিয়মের পুত্র ঈসাকে দিয়েছিলাম স্পষ্ট প্রমাণাবলী, আর আমরা তাঁকে বলীয়ান করি রূহুল কুদুস দিয়ে। -২:২৫২

এভাবে এক এক করে মহান নবীগণের গৌরব ও মহিমা লিখতে গেলে নিবন্ধের কলেবর অনেক বৃদ্ধি পাবে।

শেষকথা

শাফায়াতে কুবরা নামক ‘হাদীসের’ বর্ণনায় যে বিষয়গুলোকে বিশাল ‘অপরাধ’ হিসেবে উপস্থাপন করে মহান নবীগণকে শেষনবীর মোকাবেলায় ‘ছোট’ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে, তা কুরআনে বর্ণিত তাঁদের প্রতি আল্লাহর অকুণ্ঠ অনুগ্রহ ও দয়ার বিপরীতে কোনভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি, একগুচ্ছ অত্যন্ত খোঁড়া অজুহাত আরোপ করা হয়েছে আল্লাহর মহান নবীগণের উপর ধর্মের দূর্বৃত্তদের দ্বারা। যখন কুরআন তার চিরসত্য দ্বারা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, তখন এইসব ‘হাদীসের’ সনদের বিশুদ্ধতা অন্বেষণ করে তা সহীহ নাকি গলদ সে সিদ্ধান্ত নেয়া একেবারেই নির্বুদ্ধিতা। যখন কুরআন একাই এই বক্তব্যের অসারতা ধরিয়ে দেয়, তখন দ্বিতীয় আর সূত্রের দরকার পড়ে না তার সত্যাসত্য নির্ণয়ে।

তাই দেখা যাচ্ছে, ইসলামী লেবাসের মুনাফিকের দল একটি মিথ্যা আবিস্কার করেছে, অতঃপর সেই মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করতে আরও হাজারটি মিথ্যাকে তার চারপাশে খুঁটি হিসেবে দাঁড় করিয়েছে।

শাফায়াত কে কার জন্য কতটুকু করতে পারবেন, তা কিয়ামতের দিবসই বলে দিবে। বরং শেষনবী আমাদের বিরুদ্ধে কিয়ামতের দিন কুরআন বর্জনের অভিযোগ দায়ের করবেন- যে কুরআন আল্লাহ মানবজাতির প্রতি তাঁর করুণা এবং অনুগ্রহ এবং নেয়ামত হিসেবে পাঠিয়েছেন। আল্লাহ মেহেরবানি করে তা আগেভাগেই আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন।

وَقَالَ الرَّسُولُ يَا رَبِّ إِنَّ قَوْمِي اتَّخَذُوا هَذَا الْقُرْآَنَ مَهْجُورًا

রাসূল বললেনঃ হে আমার পালনকর্তা, আমার সম্প্রদায় এই কুরআনকে পরিত্যক্ত সাব্যস্ত করেছে। -২৫:৩০

শাফায়াত সংক্রান্ত সম্পূর্ণ মিথ্যা “সহীহ হাদীস”

সুতরাং, আল্লাহর রাসূলের নামে চালানো এই ভাষ্য কখনও রাসূলের সত্য ভাষণ হতে পারে না; বরং তা একটি ‘লাহওয়াল হাদীস’ বা অসার ও মনগড়া কথামালা। যদি কেউ এই বর্ণনাকে ‘সহীহ’ বলে দাবী করে তবে তাদের কাছে কুরআনে বাতিল বলেই গণ্য হবে। ‘শাফায়াতে কুবরাকে’ প্রচলিত মানদন্ডে ‘সহীহ হাদীস’ হিসেবে চালানো হলেও কুরআনী মানদন্ডে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমানিত।

শেষনবীর নামে ‘সর্বশ্রেষ্ঠত্বের’ মিথ্যাকে লালন-পালন এবং রক্ষা করতে মুসলিম উম্মাহর এক বড় অংশ প্রতিনিয়ত আল্লাহর সকল মহান নবী-রাসূলগণকে হেয় ও ছোট করে চলেছে যাদেরকে নবী মুহাম্মদও আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী এক্তেদা ও এত্তেবা করে গেছেন।

সর্বশেষ নবীর সর্বশ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে ডা. জাকির নায়েক আমাকে এই ‘হাদীসের’ উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন। আমি তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, নবীর শ্রেষ্ঠত্বের কথা জেনেও কিয়ামতের দিন তিনি এবং তার মত আদম সন্তানেরা কেন শেষনবীর কাছে শাফায়তের জন্য প্রথমেই না গিয়ে আদিপিতা আদম এবং অন্যান্যদের কাছে যাবেন? কীভাবে আদম সন্তানেরা সর্বশেষ নবীর নাম ভুলে গিয়ে আদমের কথা মনে করবে? কোনো আহাম্মক, বেওকুফ ব্যতীত এ জাতীয় চিন্তার প্রশ্রয় কেউ কি দিতে পারে? গল্পটির অন্তঃসারশূন্যতা কি আমাদের দিব্য চোখে ধরা পড়ে না? আমাদের কী কোনই আকল নেই?

শেষনবী ও রাসূলকে আমাদের কারও উপর উকিল নিযুক্ত করা হয় নাই।

قُلْ يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَكُمُ الْحَقُّ مِنْ رَبِّكُمْ فَمَنِ اهْتَدَى فَإِنَّمَا يَهْتَدِي لِنَفْسِهِ وَمَنْ ضَلَّ فَإِنَّمَا يَضِلُّ عَلَيْهَا وَمَا أَنَا عَلَيْكُمْ بِوَكِيلٍ () وَاتَّبِعْ مَا يُوحَى إِلَيْكَ وَاصْبِرْ حَتَّى يَحْكُمَ اللَّهُ وَهُوَ خَيْرُ الْحَاكِمِينَ

বলে দাও, হে মানবকুল, সত্য তোমাদের কাছে পৌঁছে গেছে তোমাদের পরওয়ারদেগারের তরফ থেকে। এমন যে কেউ পথে আসে সে পথ প্রাপ্ত হয় স্বীয় মঙ্গলের জন্য। আর যে বিভ্রান্ত ঘুরতে থাকে, সে স্বীয় অমঙ্গলের জন্য বিভ্রান্ত অবস্থায় ঘুরতে থাকবে। অনন্তর আমি তোমাদের উপর অধিকারী নই। আর তুমি চল সে অনুযায়ী যেমন নির্দেশ আসে তোমার প্রতি এবং সবর কর, যতক্ষণ না ফয়সালা করেন আল্লাহ। বস্তুতঃ তিনি হচ্ছেন সর্বোত্তম ফয়সালাকারী। -১০:১০৮-১০৯

সাফায়াত সংক্রান্ত কতিপয় কুরআনী আয়াত
———————————————

শাফায়াত সম্পর্কিত আমাদের সমাজে বিদ্যমান প্রচলিত বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণাকে রদ করে কুরআন আমাদেরকে ভিন্ন ও সুস্পষ্ট জ্ঞান প্রদান করে। অত্যন্ত দ্ব্যর্থহীন ভাবে জানিয়ে দেয়া হয় যে, শাফায়াত সম্পর্কিত পূর্ণ এখতিয়ার একমাত্র আল্লাহরই নিকট সমর্পিত।

আল্লাহ ব্যতীত কোন সুপারিশকারী নেই

مَا لَكُمْ مِنْ دُونِهِ مِنْ وَلِيٍّ وَلَا شَفِيعٍ أَفَلَا تَتَذَكَّرُونَ

আল্লাহ যিনি নভোমন্ডল, ভুমন্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছু ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তিনি আরশে বিরাজমান হয়েছেন। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোন অভিভাবক ও সুপারিশকারী নেই। এরপরও কি তোমরা বুঝবে না? -৩২:৪

أَمِ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِ اللَّهِ شُفَعَاءَ قُلْ أَوَلَوْ كَانُوا لَا يَمْلِكُونَ شَيْئًا وَلَا يَعْقِلُونَ

তারা কি আল্লাহ ব্যতীত সুপারিশকারী গ্রহণ করেছে? বলো, তাদের কোন এখতিয়ার না থাকলেও এবং তারা না বুঝলেও? -৩৯:৪৩

وَلَا يَمْلِكُ الَّذِينَ يَدْعُونَ مِنْ دُونِهِ الشَّفَاعَةَ إِلَّا مَنْ شَهِدَ بِالْحَقِّ وَهُمْ يَعْلَمُونَ

তিনি ব্যতীত তারা যাদের পুজা করে, তারা সুপারিশের অধিকারী হবে না, তবে যারা সত্য স্বীকার করত ও বিশ্বাস করত। -৪৩:৮৬

وَأَنْذِرْ بِهِ الَّذِينَ يَخَافُونَ أَنْ يُحْشَرُوا إِلَى رَبِّهِمْ لَيْسَ لَهُمْ مِنْ دُونِهِ وَلِيٌّ وَلَا شَفِيعٌ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ

তুমি এ কুরআন দ্বারা তাদেরকে ভয়-প্রদর্শন করো, যারা আশঙ্কা করে স্বীয় পালনকর্তার কাছে এমতাবস্থায় একত্রিত হওয়ার যে, তাদের কোন সাহায্যকারী ও সুপারিশকারী হবে না- যাতে তারা গোনাহ থেকে বেঁচে থাকে। -৬:৫১

وَذَكِّرْ بِهِ أَنْ تُبْسَلَ نَفْسٌ بِمَا كَسَبَتْ لَيْسَ لَهَا مِنْ دُونِ اللَّهِ وَلِيٌّ وَلَا شَفِيعٌ

আর এ দ্বারা স্মরণ করিয়ে দাও পাছে কোনো প্রাণ বিধবস্ত হয়ে যায় যা সে অর্জন করে তার দ্বারা, তার জন্য আল্লাহকে ছেড়ে দিয়ে অন্য কোনো অভিভাবক থাকবে না, আর না কোনো সুপারিশকারী। -৬:৭০

وَيَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَضُرُّهُمْ وَلَا يَنْفَعُهُمْ وَيَقُولُونَ هَؤُلَاءِ شُفَعَاؤُنَا عِنْدَ اللَّهِ قُلْ أَتُنَبِّئُونَ اللَّهَ بِمَا لَا يَعْلَمُ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ

আর ওরা আল্লাহকে ছেড়ে দিয়ে তার উপাসনা করে যা তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারে না বা তাদের উপকারও করতে পারে না, আর তারা বলে- এরা আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশকারী। বলো- তোমরা কি আল্লাহকে জানাতে চাও যা তিনি জানেন না মহাকাশে আর পৃথিবীতেও না? তারঁই সব মহিমা! আর তারা যাকে অংশী করে তা হতে তিনি বহু ঊর্ধ্বে। -১০:১৮

কিয়ামতের দিনকে মোকাবেলায় কুরআন সবাইকে ব্যক্তিগত প্রস্তুতির জন্য তাগিদ দেয়

يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَلَا يَشْفَعُونَ إِلَّا لِمَنِ ارْتَضَى وَهُمْ مِنْ خَشْيَتِهِ مُشْفِقُونَ

তাদের সম্মুখে ও পশ্চাতে যা আছে, তা তিনি জানেন। তারা শুধু তাদের জন্যে সুপারিশ করে, যাদের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট এবং তারা তাঁর ভয়ে ভীত। -২১:২৮

وَاتَّقُوا يَوْمًا لَا تَجْزِي نَفْسٌ عَنْ نَفْسٍ شَيْئًا وَلَا يُقْبَلُ مِنْهَا شَفَاعَةٌ وَلَا يُؤْخَذُ مِنْهَا عَدْلٌ وَلَا هُمْ يُنْصَرُونَ

আর সে দিনের ভয় কর, যখন কেউ কারও সামান্য উপকারে আসবে না এবং তার পক্ষে কোন সুপারিশও কবুল হবে না; কারও কাছ থেকে ক্ষতিপূরণও নেয়া হবে না এবং তারা কোন রকম সাহায্যও পাবে না। -২:৪৮

وَاتَّقُوا يَوْمًا لَا تَجْزِي نَفْسٌ عَنْ نَفْسٍ شَيْئًا وَلَا يُقْبَلُ مِنْهَا عَدْلٌ وَلَا تَنْفَعُهَا شَفَاعَةٌ وَلَا هُمْ يُنْصَرُونَ

তোমরা ভয় কর সেদিনকে, যে দিন এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তি বিন্দুমাত্র উপকৃত হবে না, কারও কাছ থেকে বিনিময় গৃহীত হবে না, কার ও সুপারিশ ফলপ্রদ হবে না এবং তারা সাহায্য প্রাপ্ত ও হবে না। -২:১২৩

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا أَنْفِقُوا مِمَّا رَزَقْنَاكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَ يَوْمٌ لَا بَيْعٌ فِيهِ وَلَا خُلَّةٌ وَلَا شَفَاعَةٌ وَالْكَافِرُونَ هُمُ الظَّالِمُونَ

হে ঈমানদারগণ! আমি তোমাদেরকে যে রুযী দিয়েছি, সেদিন আসার পূর্বেই তোমরা তা থেকে ব্যয় কর, যাতে না আছে বেচা-কেনা, না আছে সুপারিশ কিংবা বন্ধুত্ব। আর কাফেররাই হলো প্রকৃত যালেম। -২:২৫৪

কোন সুপারিশকারীর সুপারিশে উপকার আসবে না

أَأَتَّخِذُ مِنْ دُونِهِ آَلِهَةً إِنْ يُرِدْنِ الرَّحْمَنُ بِضُرٍّ لَا تُغْنِ عَنِّي شَفَاعَتُهُمْ شَيْئًا وَلَا يُنْقِذُونِ

আমি কি তাঁর পরিবর্তে অন্যান্যদেরকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করব? করুণাময় যদি আমাকে কষ্টে নিপতিত করতে চান, তবে তাদের সুপারিশ আমার কোনই কাজে আসবে না এবং তারা আমাকে রক্ষাও করতে পারবে না। -৩৬:২৩

وَكَمْ مِنْ مَلَكٍ فِي السَّمَاوَاتِ لَا تُغْنِي شَفَاعَتُهُمْ شَيْئًا إِلَّا مِنْ بَعْدِ أَنْ يَأْذَنَ اللَّهُ لِمَنْ يَشَاءُ وَيَرْضَى

আকাশে অনেক ফেরেশতা রয়েছে। তাদের কোন সুপারিশ ফলপ্রসূ হয় না যতক্ষণ আল্লাহ যার জন্যে ইচ্ছা ও যাকে পছন্দ করেন, অনুমতি না দেন। -৫৩:২৬

فَمَا تَنْفَعُهُمْ شَفَاعَةُ الشَّافِعِينَ

অতএব, সুপারিশকারীদের সুপারিশ তাদের কোন উপকারে আসবে না। -৭৪:৪৮

وَلَمْ يَكُنْ لَهُمْ مِنْ شُرَكَائِهِمْ شُفَعَاءُ وَكَانُوا بِشُرَكَائِهِمْ كَافِرِينَ

তাদের দেবতা গুলোর মধ্যে কেউ তাদের সুপারিশ করবে না। এবং তারা তাদের দেবতাকে অস্বীকার করবে। -৩০:১৩

وَأَنْذِرْهُمْ يَوْمَ الْآَزِفَةِ إِذِ الْقُلُوبُ لَدَى الْحَنَاجِرِ كَاظِمِينَ مَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ حَمِيمٍ وَلَا شَفِيعٍ يُطَاعُ

আপনি তাদেরকে আসন্ন দিন সম্পর্কে সতর্ক করুন, যখন প্রাণ কন্ঠাগত হবে, দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হবে। পাপিষ্ঠদের জন্যে কোন বন্ধু নেই এবং সুপারিশকারীও নেই; যার সুপারিশ গ্রাহ্য হবে। -৪০:১৮

অতএব, আর বেশি বাক্যব্যয় নয়। বাজারে প্রচলিত ‘শাফায়াতের’ গল্পে ভুলে আমরা যেন আমাদের বিচার দিবসের প্রস্তুতির বিষয়ে উদাসীন-গাফেল হয়ে না যাই। আল্লাহই সম্যক অবগত।

[আমার লেখার বিপরীতে ডা. জাকির নায়েক কর্তৃক এই হাদীস দিয়ে শেষনবীর সর্বশ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদনের উত্তরে লিখিত। ইমাম-আলেম-উলামা, স্কলার দাবীদার সকলের কর্তব্য কুরআন দিয়ে এই লেখায় যদি কোন ভুল থাকে তা ধরিয়ে সংশোধন করে দেয়া; আর যদি তা শুদ্ধ বলে প্রতিয়মান হয়, তবে এই সত্যকে স্বীকার করে নিয়ে জনসমক্ষে ঘোষণা দিয়ে তা জানিয়ে দেয়া।]

*******************************