Ramadan?

রমজান রোজা নয়; রোজাও রমজান নয়।

আরবিতে ‘সিয়াম’, পার্শীতে ‘রোজা’ আর বাংলায় ‘উপবাস’বা কৃচ্ছ সাধনা। রমজান আরবি চন্দ্র মাসের নবম ও সবচেয়ে ছোট মাসটির নাম।

বিশ্বে বর্ষ বা সময় গণনার প্রধান দু’টি উৎস: সৌর বর্ষ ও চন্দ্র বর্ষ। ছোট বেলার ভূগোলে শেখা যে গ্রহ-নক্ষত্রের ঘুর্ণন, আবর্তন-বিবতনের কারণে পৃথিবীর আহ্নিক গতির ফলে দিবারাত্র ও বার্ষিক গতির ফলে প্রায় ৩৬৫ দিনে বছর ও স্থানভেদে ২/৪ ও ৬ ঋতুর পরিবর্তন হয়। এই পরিবর্তনকে লক্ষ্য করে ৩৬৫ দিনকে ১২ ভাগে ভাগ করেছে; যার প্রত্যেক অংশকে মাস বলে। অতঃপর মাসকে সপ্তাহ, দিন, ঘণ্টা, মিনিট ও সেকেন্ডে ভাগ করা হয়েছে।

কোরানে ঐ ১২ ভাগের নির্দিষ্ট একটি মাসের দিনের অংশে উপবাস পালনের নির্দেশ রয়েছে। নির্দেশ রয়েছে সূর্য উদয় থেকে ডোবা পর্যন্ত পানাহার ও যৌন ভোগ-বিলাস নিষিদ্ধ। নির্দিষ্ট রয়েছে সময়ের কোন মুহুর্ত পর্যন্ত উপবাস থেকে কখন ভঙ্গ করবে। অর্থাৎ রোজার চরিত্র, বৈশিষ্ট ও পরিচয় বহন করে একমাত্র সৌরকাল, চন্দ্রকাল নয়।

চন্দ্র দিন রাত্র করে না, উপবাস শুরু ও ভঙ্গের সময় নির্ধারণ করে না, সকাল সন্ধ্যা করে না, নামাজের সময় বলে দেয় না, ছেহরি-ইফতারের সময় বলে দেয় না। অর্থাৎ্ রোজা-নামাজ পালনে চন্দ্র সময়ের কোন ভূমিকা নেই, একমাত্র হজ্জের দিনটি ছাড়া। তবুও এই চাঁদকে নিয়ে আদিকাল থেকেই বছরের নির্দিষ্ট কতিপয় ধর্মীয় পর্বের সময়কাল নিয়ে মুছলিম বিশ্বে যত ঝগড়া ফাছাদ তথা অধর্ম চলছে, বিশ্বের অন্য কোন ধর্মে এমন কোন নজির নেই। হাস্যকর বিষয় যে, শরিয়ত দৈনিক রোজাটি পূরণ করে সূর্য দেখে; মাসটি পুরণ করে চন্দ্র দেখে আর বছরটি পুরণ করে সূর্য দেখে! বলাবাহুল্য, হজ্জের অনুষ্ঠানটি নিয়ে এমন ঝগড়া ফাছাদ বা মত বিরোধ হয় না বটে!

কারণ:

১. নির্দিষ্ট একটি ভূখণ্ডে, নির্দিষ্ট একটি সময় পৃথিবীর সকল মুছলিম হাজির হয় বলে।

২. সৌদি রাজার কোরান বিবর্জিত একক মতে হজ্জের দিন তারিখ ধার্য হয় বলে।

এই ঝগড়া-ফাছাদ বন্ধ হতে পারে:

ক. পৃথিবীর সকল মুছলিমগণ রমজান মাসে আরব দেশে হাজির হয়ে রোজা, ঈদ পালন করলে।

খ. সঠিক হোক বা ভুল হোক মুছলিম বিশ্ব একক ব্যক্তির আদেশ মান্য করলে।

গ. চাঁদটি গুলি করে ভূপাতিত করলে।

ঘ. একমাত্র কোরান অনুসরণ করলে এ সমস্যা সমাধান সম্ভব।

সমস্যার কারণ একমাত্র চন্দ্র বর্ষ। চন্দ্র বর্ষ হয় ৩৫৪ দিনে; পক্ষান্তরে সৌর বর্ষ হয় প্রায় ৩৬৫ দিনে। সৌর বর্ষের তুলনায় চন্দ্র বর্ষে ১১ দিন কম। মূলত ৩৬৫ দিনেই বছর হয়, আর তাই ১১ দিনের ঘাটতি পূরণের জন্য আগামী বছর থেকে কাল্পনিক ও অবৈজ্ঞানিকভাবে ১১ দিন ধার করে এনে চন্দ্র বছর ৩৬৫ দিন পুরো করে একটি বছর ধার্য করা হয়। আর এ কারণেই চন্দ্র মাস প্রতি বছর ১১ দিন পিছু হটতে থাকে এবং মাসগুলি ঘুরতে থাকে; অর্থাৎ চন্দ্র মাসের ১২টি নাম ঠিক থাকলেও তার নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য থাকে না; থাকে না তার নির্দিষ্ট পরিচয়। ফলে ১২টি মাসেই এমনকি বছরের প্রত্যেকটি দিনেই কালের ব্যবধানে রমজান, মুহররম বা শাবান নাম ধারণ করে। অতএব সে হিসাবে মুছলিমগণ বছরের প্রত্যেকটি মাস ও দিনেই রোজা রাখে।

আজকের মুছলিম সমাজের ধর্মীয় পর্বগুলির দিন তারিখ চন্দ্র বর্ষ অনুসরণ করে বলেই কখনও জানুয়ারি-ফেব্র“য়ারি, কখনও জানুয়ারি-ডিসেম্বর আবার কখনও ডিসেম্বর-নভেম্বর ইত্যাদি চক্রকারে রোজা রাখে। ফলে কোরানে নির্দেশ চরমভাবেই লঙ্ঘিত হচ্ছে। অর্থাৎ কোরানের আলোকে সময়ের হিসাবে তাদের রোজা ঈদ সবই সন্দেহজনক বলেই মনে হয়!

মুছলিম বিশ্বের শুধু রোজা ঈদই নয়, ধর্মীয় সমস্ত পর্বগুলি, যেমন রাছুলের জন্ম তারিখ, শবে কদরের নির্দিষ্ট রাত, কোরবানীর তারিখ, মে’রাজের তারিখ সবই চাঁদের ফাঁদে পড়ে প্রায় ১৪ শত বছর যাবত ঘুরে ঘুরে আজ তা কোথায় অবস্থান করছে তা কারো জানা নেই।

মোঘল সম্রাট আকবরের শাসন আমলে ভারতবর্ষে চন্দ্র বর্ষ চালু ছিল। প্রজাদের অনুরোধ ছিল ধানের মওসুমে এসে খাজনা আদায় করতে। সে বছর বাংলা পৌষ মাসে প্রধান ফসল ধানের মওসুম ছিল, তাই ধান বিক্রয় করে সহজেই সরকারের খাজনা পরিশোধ করলো। পরের বছরও খাজনা পরিশোধ করতে মাত্র ১১ দিনের হেরফের ছাড়া তেমন সমস্যা হয়নি। কিন্তু তার পরের বছর নির্দিষ্ট পৌষে খাজনা আদায় করতে এসে সরকার দেখলো যে, এবারের পৌষ মাসে ধান পাকেনি। কারণ চন্দ্র বর্ষের গুণে ২ বছরে বাংলা পৌষ মাস পিছিয়ে বাংলা অগ্রহায়ণের ২২ দিনের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম তো আর ২২ দিন পিছিয়ে ধান পাকাতে পারে না! অতএব এবারের পৌষে ধানও পাকেনি আর তাই খাজনাও আদায় করা সম্ভব হয় নি। এ সমস্যার কথা সম্রাট আকবরকে জানালে তার সমাধানস্বরূপ চন্দ্র বর্ষের পরিবর্তে সৌর বর্ষ প্রবর্তন করে ধান পাকার মওসুম পৌষে নির্দিষ্ট করে মাসের নড়চড় বন্ধ করে খাজনা আদায়ের সময়কাল নির্দিষ্ট করা হয়।

পৃথিবী গোল হওয়ার কারণে এবং আহ্নিক গতি ও বার্ষিক গতির ফলে একই দেশে এবং বিভিন্ন দেশের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের সময়ের পার্থক্য ১ মিনিট থেকে প্রায় ১০/১১ ঘণ্টা পর্যন্ত হয়ে থাকে। এমতাবস্থায় চাঁদের আবির্ভাব ও তিরোধান বড়ই স্পর্শকাতর ও রহস্যময়। কারণ দিন-রাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যে কোন সময় অসময় প্রতিপদ (জন্মলগ্ন) লাগতে পারে, আর এই প্রতিপদ লাগার ২০/২২ ঘণ্টা পরে মাত্র কয়েক মিনিট বা সেকেন্ডের জন্য চাঁদের উদয় হয়। এমতাবস্থায় নির্দিষ্ট একটি দেশের এক প্রান্তের স্থানীয় সময় উদাহরণ স্বরূপ বেলা ১২টা ৫ মিনিটে প্রতিপদ লাগলে পরের দিন ভোর ৮/১২টা ৫মি: ঐ আকাশে মুহুর্তের জন্য চাঁদ উঠবে। কিন্তু তখন প্রখর সূর্যের আলোর জন্য অথবা আকাশ মেঘাচ্ছন্ন বা প্রাকৃতিক দূর্যোগের জন্য এমন কি দূরবীণ বাইনোকুলার দ্বারাও তা দর্শন করা সম্ভব হয় না; তাছাড়া যন্ত্রগুলি চোখে লাগাতে লাগাতে বা খুজতে খুজতেই চাঁদ উঠে পুনঃ অস্ত যাবে। অথচ আকাশে চাঁদ উঠেছিল; পরের দিনের চাঁদের বড় আকৃতি দেখেই বোঝা যায় যে গত দিনই আকাশে চাঁদ উঠেছিল। এমতাবস্থায় দেশের অপর প্রান্তে যেখানে সময়ের এমনকি ২/৫ মিনিটেরও পার্থক্য থাকে সে প্রান্তের আকাশে চাঁদ দেখার কোন প্রশ্নই উঠে না। এই সময়ের পার্থক্যের কারণে একই দেশের এক প্রান্তের উদিত চাঁদ দর্শন হলেও অপর প্রান্তের লোকদের তা দেখা সম্ভব নয়। ফলে মুছলিম দেশগুলিতে অথবা একই দেশের দুই প্রান্তের লোকদের মধ্যে হয় মত বিরোধ। ফলে একদলের ঈদের দিনে অন্য দল রোজা রাখে, অন্যের রোজার দিনে ঐ দল ঈদ করে। অর্থাৎ একদলের দৃষ্টিতে অন্যদল অবৈধ তথা হারাম! বস্তুতঃপক্ষে কোরানের আলোতে উভয় দলই অবৈধ বলে ধারণা হয়।

একই দেশের চাঁদ দর্শন নিয়ে যখন এরূপ সমস্যার উদ্ভব হয়, তখন আরব বা পাকিস্থানের আকাশের উদিত চাঁদ দর্শনের খবর পেয়ে বিশ্বের সকল দেশের রোজা ঈদ পালন করা কি করে বৈধ বা যুক্তিসঙ্গত হতে পারে! মূলত চন্দ্র, সূর্য ও গ্রহ-নক্ষত্রাদি সকল সময়, সকল অবস্থায়ই আকাশে থাকে। এমন কি অমাবস্যার রাতেও স্থানভেদে চাঁদ দর্শন করা সম্ভব। এই চাঁদ দেখে রোজা ঈদ পালনের বিধান থাকলে, অদূর ভবিষ্যতে মানুষ যদি কখনও চন্দ্র, মঙ্গল অথবা অন্য কোন গ্রহে বসবাসের উপযোগী করতে পারে ; তখন এই কোরান সেখানে অচল হয়ে পড়বে।

‘কোরান সমগ্র মানব জাতির’ কথাগুলি আজকের সমাজ মৌখিক বিশ্বাস করে মাত্র ; কিন্তু বাস্তবে প্রমাণ করার ক্ষমতা, জ্ঞান আজ দেড় হাজার বছরের মধ্যেও আমরা কেউ অর্জন করতে পারিনি।

মুহম্মদ চন্দ্র বর্ষের প্রবর্তন করেননি। (তথ্যসূত্র: দৈনিক ইনকিলাব: ১৮৯ তম সংখ্যা, ১১ ডিসেম্বর ১৯৮৭)। আবুবকর পর্যন্ত রোজা বা ঈদ আজকের রোজার মত পা-পা করে পিছু হটতো না। রমজান, রমজানের জায়গায়ই নির্দিষ্ট থাকতো। কিন্তু ওমরের আমল থেকে সৌরবর্ষ ছেড়ে চন্দ্রবর্ষ চালু হয়। (সংক্ষিপ্ত ইছলামী বিশ্বকোষ: ২য় খ. ২য় সস্করণ; পৃ: ৫০৭, ৫০৮; ই. ফা; ইছলামের ইতিহাস, ছেহা-ছেত্তা ইত্যাদি)। সেই থেকে আজ পর্যন্ত রমজান প্রতি বছর ১১দিন পিছু হট্ছে।

অনেকের ধারণা যে, ‘রাছুলের পূর্ব থেকেই চন্দ্রমাস চালু ছিল;’ কিন্তু রাছুল সেই চন্দ্র বর্ষের কোন্ সন তারিখে জন্ম-ওফাত্ করেছেন, ২৩টি যুদ্ধের চন্দ্র সন-তারিখ কি ছিল! তা বিশ্বের কারোরই জানা নেই, দলিলপত্রও নেই। উপরন্তু সকল ইতিহাস-হাদিছেই সৌর সন-তারিখের (খ্রিষ্টাব্দের) উল্লেখ বা দলিলপত্র পাওয়া যায়। মূলত খলিফা ওমর পূর্বের সৌরসনের পরিবর্তে চন্দ্রসন প্রবর্তন করলেও মাসগুলির নাম পরিবর্তন করেননি বলেই শরিয়ত অবাস্তব সন্দেহ করে মাত্র।

এক্ষণে আরবগণ চন্দ্রবর্ষ ছেড়ে সৌরবর্ষ প্রবর্তন করলে, লীপ ইয়ারের সমস্যা ছাড়া রমজানসহ রাছুলের জন্ম-মৃত্যু তারিখ, শ’বে কদর, মে’রাজ ইত্যাদি যাবতীয় ধর্মীয় দিন-ক্ষণগুলি স্থায়ী হয়ে যাবে; বছর বছর ১১ দিন পিছু হটবে না; ৯ম মাস রমজান, ৯ম মাস পৌষের রোজা জুলাই বা চৈত্রে ঢুকবে না।

আরব দেশ বা দল, উপ-দলিয় ইমামদের অনুসরণ/অনুকরণ করা মুছলিমদের ধর্ম নয়, কোরান অনুসরণ করাই ধর্ম।

রোজার সময়কাল সম্বন্ধে উপরোল্লিখিত বিষয়গুলি প্রাকৃতিক, বৈজ্ঞানিক ও বাস্তব সত্য বলেই স্বীকার করতে হয়। অতএব, কোরান যদি এ সমস্যাগুলির সমাধান দিতে না পারে তবে স্বীকার করতেই হবে যে:

ক. কোরান পূর্ণ জীবন বিধান নয়।

খ. কোরানের প্রকৃত অর্থ উদ্ধার করতে আলেম-আল্লামাগণ ব্যর্থ হয়েছেন।

গ. স্ব-জ্ঞানে, স্ব-ইচ্ছায় জেনে-শুনে কোরান অমান্য করে দলিয় স্বার্থে সৌদি আরবকে অনুকরণ করছে।

প্রথম ধারাটি স্বীকার করার শক্তি-সাহস বিশ্বের একজন মুছলিমেরও নেই; যদিও শরিয়ত তা প্রমাণ করতে ব্যর্থ। অতঃপর দ্বিতীয় ধারাটি অবিশ্বাস্য হলেও সত্য; তৃতীয় ধারাটি আরো সত্য; যেহেতু দ্বিতীয় খলিফা ওমরের চন্দ্র বর্ষ চালু করার পর থেকে অদ্যাবধি প্রায় দেড় হাজার বছরের মুছলিম বিশ্বের সমূহ ধর্মীয় পর্বগুলির দিন-ক্ষণগুলি চাঁদের ফাঁদে পড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে। অতএব এ সম্বন্ধে কোরানের উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ আয়াতাংশগুলি একান্তভাবেই লক্ষণীয় :

১। আইয়্যা-মাম্মা’দুদাত। (২: বাকারা-১৮৪) অর্থ: নির্দিষ্ট কতিপয় দিন মাত্র।

নির্দিষ্ট কিছু দিন বলতে ৩৬৫ দিনের ১২ ভাগের নির্দিষ্ট একটি ভাগকে বুঝায়; ঐ নির্দিষ্ট ভাগ বা মাসের নির্দিষ্ট গুণাগুণ বা বৈশিষ্টও থাকে। কিন্তু চন্দ্র বছরে এ ধরনের মাসের কোন নির্দিষ্টতা নেই। অর্থাৎ ৩৬৫ দিন তথা প্রত্যেকটি মাসই পর্যায়ক্রমে মহররম, রমজান বা শাবান ইত্যাদি নাম ধারণ করে থাকে; যা পূর্বেই আলোচিত হয়েছে। তাই ৩৩ বছর যিনি লাগাতার রোজা রেখেছেন, তিনি বছরের প্রত্যেকটি মাস তথা প্রত্যেকটি দিনেই রোজা রেখেছেন।

অতএব, আজকের মুছলিম সমাজ পর্যায়ক্রমে ১২ মাস বা ৩৬৫দিনই রোজা পালন করে থাকেন। অর্থাৎ অনির্দিষ্ট কাল ব্যাপীয়া রোজা পালন করেন। ফলে উল্লিখিত নির্দেশটি চরমভাবেই লঙ্ঘিত হচ্ছে।

২। ফামান কা-না…উখারা…। (২: বাকারা-১৮৪) অর্থ: তোমাদের মধ্যে কেহ অসুস্থ থাকলে বা প্রবাসী/বিদেশী/ ভ্রমণে থাকলে অন্য সময় হিসাব করে রোজা রাখবে।

উল্লিখিত আয়াতে রোগীদের আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। এখানে ‘সফর’ শব্দটি উল্লেখযোগ্য। তার সাধারণ অর্থ ভ্রমণ, অতঃপর: (স্থান) ত্যাগ করা; স্থানান্তরিত হওয়া; বিচ্ছিন্ন হওয়া; অনুপস্থিত থাকা ইত্যাদি বুঝায় (দেখুন: আরবি-ইংরেজি অভিধান; বাই জে. এন. কাউয়ান)। মূল কথা হলো বিদেশী বা প্রবাসীগণ অন্য সময় অর্থাৎ নিজ নিজ হিসাব অনুযায়ী রোজা রাখবে, যখন ইচ্ছা তখন নয়।

আরবি ‘সফর’ এর ‘ভ্রমণ’ অর্থটি অত্যন্ত ব্যাপক ও রূপক; ভ্রমণ বলতে দু’চার ঘণ্টা থেকে দিন, সাপ্তাহ, মাস, বছর থেকে ২/১০ বছরও হতে পারে। অতএব এমতাবস্থায় কেউ ৫ বছর বিদেশে অবস্থান করে দেশে ফিরে বর্তমান বছরসহ গত ৫ বছরের মোট ৬ মাস লাগাতার রোজা পালন করবে; এটা কোন অবস্থাতেই যুক্তিসঙ্গত নয়। ভ্রমণের দীর্ঘতার কারণে লাগাতার ১ বছর বা ততোধিক রোজা রাখতেও হতে পারে। অবশ্য এই ‘সফর’ সম্বন্ধে ফেকহা, এজমায় কিছু দুর্বল ব্যক্তিগত এবং বিতর্কিত মত প্রচলিত আছে।

অপরপক্ষে ২/১০ ঘণ্টা থেকে দু’চার দিন ভ্রমণে থাকলে ঐ দিন বা সময়কালে রোজা না রেখে নির্ধারিত রোজা শেষে অন্য সময় তা পালন করারও কোন যুক্তি থাকতে পারে না। কারণ এ রকম খুচরা ভ্রমণ সমাজের ৫০% শতাংশ লোকেই অহরহ করে থাকে এবং ব্যক্তি ও সমাজ জীবন ধারনের তাগিদে করতেই হয়। অতএব রোজার মাস বলতে তখন নির্দ্দিষ্ট মাসের অস্তিত্বই থাকে না।

সফর থেকে ‘মুসাফির’, বাংলায় প্রবাসী, আগন্তুক, বিদেশী বা পর্যটক। আপন দেশ, এলাকা ত্যাগ করে অন্য দেশে বা এলাকায় অবস্থান বা ভ্রমণ করাকেই মুসাফির বা প্রবাসী বলে। তাছাড়া আপন দেশ ব্যতীত অন্য সকল দেশের লোকই বিদেশী বা প্রবাসী। এই প্রবাসী বা বিদেশীদের জন্যই অন্য সময় গণনা বা হিসাব করে রোজা রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে কোরানে। গোল পৃথিবীর কারণে নির্দিষ্ট একটি স্থানের নির্দিষ্ট একটি সময় পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে আমুল হের ফের হয়। সময়ের হিসাব বলতে যেমন: ‘বাংলাদেশ সময় ২ তারিখ বেলা ১০ টার সময় ভূমিকম্প হয়েছে;’ সেই সময়টা হিসাব-নিকাশ করে আমেরিকার সময় দাঁড়ায় ১ তারিখ রাত্র ৮ টার সময়। ২৪ ঘণ্টায় যদি ১০ ঘণ্টার পার্থক্য হয় তবে ১ বছরে কত পার্থক্য হবে! সেটা হিসাব-নিকাশ করে সময়-কাল ধার্য করাকেই কোরানের আলোকে ‘প্রবাসীদের অন্য সময় গণনা করে’ রোজা রাখার নির্দেশ বুঝিয়েছে।

মাস বলতে নির্দিষ্ট একটি আবহাওয়া, জলবায়ু ও পরিবেশকে বুঝায়। কোরান নাজিল হয়েছে আরব দেশে তাই আরবের একটি নির্দিষ্ট মাসে রোজা রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মাসটি আরবি রমজান মাস। আরব ভিন্ন অন্য কোন দেশে নবীর আগমণ হলে সেই দেশেরই ফজিলতের মাসটি রোজার জন্য নির্দিষ্ট হতো ; বাংলাদেশে আগমণ হলে ফজিলত বা কল্যাণের মাস হিসাবে পৌষ মাসকেই যে নির্দিষ্ট করা হতো, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। অতএব রমজান মাসের নির্দিষ্ট আবহাওয়া, জলবায়ু অর্থাৎ সামগ্রিক কল্যাণ-ফজিলত অন্য দেশের যে মাসটির মধ্যে পাবে ঠিক সেই মাসটিই কোরানের ভাষায় প্রবাসীদের অন্য সময় হিসাব করে রোজা রাখার মাস বুঝিয়েছে।

১২টি মাসের মধ্যে তুলনামূলকভাবে রমজান মাসকেই শ্রেষ্ঠ কল্যাণের মাস হিসাবে ঘোষিত আছে। অতএব প্রত্যেকটি দেশের স্ব-স্ব ১২টি মাসের মধ্যে বিচার বিবেচনায় তুলনামূলকভাবে যে মাসটি শ্রেষ্ঠ কল্যাণের বিবেচিত হবে, ঠিক সেই মাসটিকেই কোরানের ভাষায় ‘প্রবাসীদের অন্য সময় গণনা করে রোজা রাখার মাস বলেই ইঙ্গিত দিয়েছে।

উল্লিখিত বর্ণনা আয়াতটির ব্যাখ্যা নয় বরং সরলার্থ এবং ইহাই যে যুক্তিসঙ্গত ও নিরপেক্ষ এবং কোরানসম্মত তা পরবর্তী আয়াতে স্বচ্ছ আয়নার মত পরিস্কার করে দিয়েছে।

৩। ফামান সাহেদা…উখারা…। (২: বাকারা- ১৮৫) অর্থ: সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এই মাসটি পাবে/উপস্থিত থাকবে/ প্রত্যক্ষ করবে/ সাক্ষী থাকবে তারা যেন এই মাসেই রোজা রাখে। এবং যারা অসুস্থ ও প্রবাসী/বিদেশী /সফরে থাকলে তারা অন্য সময় গণনা করে পূরণ করবে।

আয়াতটি সহজ-সরল ও ব্যাখ্যাসহ অবতীর্ণ। এতে নতুন করে ব্যাখ্যার অবকাশ নেই। তবুও দেড় হাজার বছর যাবৎ আমাদের এই সহজ সরল বিষয়টা বোধগম্য হচ্ছে না বলেই একই কথা বার বার ওলট-পালট করে বলতে হয় এবং কোরানেও অনুরূপ বলা আছে। মাস বলতে ৩৬৫ দিনের এক ভাগকে বুঝায় ; মাস বলতে নির্দিষ্ট একটি আবহাওয়া ও জলবায়ুকে বুঝায়। নির্দিষ্ট একটি দেশের হিসাব করা মাস পৃথিবীর সকল দেশের লোক ২/১০ ঘণ্টার ব্যবধানে প্রায় একই সঙ্গে মাসটির বৈশিষ্ট্য প্রত্যক্ষ বা সাক্ষী থাকতে পারে না, তা পূর্বেও আলোচিত হয়েছে।

আরবের লু-হাওয়ার প্রত্যক্ষ সাক্ষী আরবগণ; আমেরিকা-ইউরোপের তুষার বরফ পড়ার মাসের প্রত্যক্ষ সাক্ষী স্ব স্ব দেশীয়গণ; বাংলাদেশের চৈত্রের টাক ফাটা রোদ, ঘাম ঝরা গরম বা কাল বৈশাখী ঝড়ের প্রত্যক্ষ সাক্ষী বাংলাদেশীগণ। আর সকল ভিন্ন দেশীগণ তার পরোক্ষ সাক্ষী। অর্থাৎ তারা ভোগ করে না, দেখে না বা প্রত্যক্ষ সাক্ষী থাকে না ; কিন্তু জানে যে, কোন্ দেশে, কোন্ মাসে কখন কি অবস্থা ধারণ করে; এর মানেই তারা পরোক্ষদর্শী।

একই সৌরমাস গণনায়ও যেখানে আমেরিকার জানুয়ারি-ফেব্র“য়ারি, বাংলার বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ বা আষাঢ়-শ্রাবণ ইউরোপ/আমেরিকায় প্রত্যক্ষ করা যায় না! সেখানে সৌর ভিন্ন আরবের চন্দ্র বর্ষের হিসাব করা মহরম/রমজান মাস একই সময় অন্য কোন দেশে প্রত্যক্ষ করা বা সাক্ষী থাকা একেবারেই অবাস্তব। এজন্যই আয়াতে বলা হয়েছে যে, ‘উক্ত মাস যারা প্রত্যক্ষ করে বা সাক্ষী থাকে তারা যেন এই মাসে রোজা রাখে; দূরদেশী/প্রবাসী ও রোগী অন্য সময় গণনা করে রোজা রাখবে’ অর্থাৎ আরবে যারা বসবাস করে তাদের জন্য রমজান (সৌর হিসাব অনুযায়ী) এবং আরব ভিন্ন অন্য দেশীরা সময়কালের হিসাব-নিকাশ করে তাদের রোজার মাস বের করে নিবে। আয়াতে বর্ণিত ‘যারা প্রত্যক্ষ করে বা সাক্ষী থাকে’, তার অর্থই সকলেই উক্ত মাস প্রত্যক্ষ করে না বা সাক্ষী থাকতে পারে না। এখানে ‘যারা’ ও ‘প্রত্যক্ষ’ শব্দদ্বয়ের অর্থ বুঝতে কলেজ ইউনিভারসিটির ডিগ্রির প্রয়োজন নেই। তবুও আজ এ দু’টি শব্দ বোঝার সহজ-সরল জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ পেয়ে গেছে! অথবা আমরা জেনে শুনেই কোরানের অমোঘ বাণী অবহেলা করছি!

উল্লিখিত বর্ণনা আয়াতটির তফসীর ব্যাখ্যা নয় বরং পূর্ববৎ সরলার্থ এবং ইহাই যে কোরানিক যুক্তিসঙ্গত তা পরবর্তী আয়াতে আরো স্বচ্ছ আয়নার মত পরিস্কার করে দিয়েছে।

৪। ইউরিদুল্লাহু…অছরা…। [২: ১৮৫] অর্থ: আল্লাহ তোমাদের সহজ ও আরামের মধ্যেই রোজা চাহেন; তোমাদের কষ্ট ক্লেশ হোক তা মোটেই চাহেন না।

রোজা রাখার কষ্ট ক্লেশ শিথিল করে আরাম আয়েশ ভোগের সুযোগ-সুবিধা একমাত্র রোগী ও প্রবাসী বা ভ্রমণকারীদের জন্যই যে বিধিবদ্ধ করেছেন তা সঙ্গত নয়। বরং সকল রোজাদারীর জন্যই এ সুযোগটি অবস্থাভেদে সমান প্রযোজ্য বটে! অর্থাৎ স্থান, কাল ও পাত্র ভেদে সমান এবং সর্বোচ্চ সুবিধা গ্রহণের নিশ্চয়তা দেয় এই আয়াতটি।

আবহাওয়া, জলবায়ু ইত্যাদির নিরীখে প্রত্যেকটি মাসের গুণাগুণ, আরাম-আয়েশ বা ফজিলত সমান নয়। পৌষের ৮/৯ ঘণ্টা উপবাস আর চৈত্রের টাক ফাটা গরমের ১৪/১৫ এমনকি দেশভেদে ২০/২২ ঘণ্টা উপবাসে দেহ-মনের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া বা ফজিলত অবশ্যই সমান কল্যাণকর যে নয় তা ১২ বছরের শিশুও সাক্ষী দিতে পারে। অতএব প্রত্যেকটি জাতির ১২টি মাসের মধ্যে তুলনামূলকভাবে নিশ্চয়ই একটি সহজ আরামের বা ফজিলতের মাস আছেই আছে। কোরানে ‘প্রবাসীগণ অন্য সময় হিসাব করে রোজা পূরণ করবে’, সে হিসাবটি প্রত্যেক জাতির কল্যাণকর মাসটিকেই ইঙ্গিত করেছে। রমজান মাস তুলনামূলকভাবে ১২টি মাসের তুলনায় কল্যাণকর তথা ফজিলতের মাস ছিল বলেই রোজার জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছিল; কিন্তু চন্দ্রবর্ষ চালু করার পর তা আর অবশিষ্ট নেই। রমজান মাস কেমন এবং কেন ফজিলতের মাস ছিল, সেটা সহজভাবে বোঝার জন্য প্রত্যক্ষদর্শী ও প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসাবে নিচে বাংলা পৌষ মাস এবং ইউরোপ-আমেরিকার ফেব্র“য়ারীর উদাহরণটিই উপযুক্ত মনে করা যায়:

১. এ মাসের দিনগুলি সবচেয়ে ছোট, মাত্র ৮/৯ ঘণ্টার।

২. মাসটিও সবচেয়ে ছোট, মাত্র ২৮/২৯/৩০ দিনের।

৩. আবহাওয়া ও জলবায়ু আরামপ্রদ ও স্বাস্থ্যপ্রদ।

৪. রোগ-শোক তথা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আসমানী বালা, জমিনী বালা মুক্ত।

৫. নিত্য নতুন এবং হরেক রকমের খাদ্য শস্যের মওসুম তথা অভাব অভিযোগ মুক্ত।

৬. প্রচণ্ড কাজ করার উপযুক্ত আবহাওয়া ও পরিবেশ।

৭. ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ, ভ্রমণ, অতিথি আদর-আপ্যায়ণ, প্রকাশ্যে সমাবেশ, মহা সমাবেশ ইত্যাদিতে প্রকৃতি কোন বাধা বা প্রতিকুলতার সৃষ্টি করে না।

৮. এ সময় দিনটি ছোট, মাসটি ছোট, তাপহীন হেতু নিতান্ত বৃদ্ধ ও ছোট শিশুগণও আনন্দ, উৎফুল্ল ও স্বতঃফুর্তভাবে উপবাস পালন করতে সক্ষম ও আগ্রহশীল হয়।

৯. উপবাস ব্রতে দেহের সুষ্কতার সঙ্গে প্রাকৃতির সুষ্কতা বহুল পরিমাণে সাহায্য করে।

১০. মানুষের হৃদয়-মন মুক্তাকাশ ও পরিবেশের মতই নির্মল, সজিব ও উদার থাকে; ঝামেলা মুক্ত হৃদয় খুলে আল্লাহকে ডাকার, ধ্যান, সাধনার সময়-সুযোগ পায়।

বিজ্ঞান, জ্যোতিষ বিজ্ঞানই নয়, চাষা-কুলি এমনকি পশুদের মতেও ১২টি মাসের মধ্যে এ মাসটি বিচার বিশ্লেষণে উপবাস পালনের সহজতর মাস অর্থাৎ রহমতের মাস বলেই বিবেচিত হয়। এ মাসটি রোজাদারীর জন্য কষ্ট ক্লেশহীন তথা আরামদায়ক ও কল্যাণকর। এমন সুযোগ সুবিধা ও গুণাগুণ রমজান মাসে বিদ্যমান ছিল বলেই আল্লাহ রমজান মাসে রোজা রাখার সময় ধার্য করেছিলেন। কিন্তু ওমরের আমল থেকে চন্দ্র বর্ষ চালু করার কারণে আজ তা লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছে। প্রত্যেক দেশ বা জাতির তুলনামূলকভাবে এমন একটি কল্যাণকর মাস অবশ্য অবশ্যই আছে। রমজান বলতে প্রত্যেকের সেই মাসটিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে এমন একটি মাস আছে যখন:

১. দিনটি থাকে সবচেয়ে বড় ১৫/১৬ ঘণ্টার; কোন দেশে ২০/২২ ঘণ্টাও হয়।

২. মাসটি থাকে সবচেয়ে বড়, ৩১ দিনে।

৩. তখন খাদ্যশস্যের থাকে চরম অভাব; এমনকি মধ্যবিত্তের ঘরেও দু’মুঠো খাদ্যের যোগান থাকে না।

৪. ঝড় বাদল, জলোচ্ছাস, হাজারো রকমের আসমানী জমিনী বালা মছিবত তথা দুর্যোগে থাকে ভরপুর।

৫. চলাফেরা, ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ প্রকৃতি চরমভাবে প্রতিকুল অবস্থা ধারণ করে।

৬. প্রচণ্ড গরমে এমনকি পশু-পক্ষী, জন্তু-জানোয়ার পর্যন্ত পানিতে আশ্রয় নেয়।

৭. মারাত্বক রোগ-শোক, মহামারি ইত্যাদির প্রাদুর্ভাব থাকে।

৮. প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মাঠে ময়দানে এমনকি ঈদের নামাজ পর্যন্ত করা সম্ভব হয় না। ঈদের যাবতীয় আনন্দ আয়োজন মুহুর্তের মধ্যেই লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়! জীবন, সংসার নিয়েই ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়, ফলে একনিষ্ঠ সাধন-ভজন বা ধর্মানুশীলণ অতিরিক্ত বোঝা হয়ে দেখা দেয়।

৯. বৃদ্ধ, শিশু এমন কঠিন দিনে রোজা রাখতে ভয় পায়; অভাব, অস্বাস্থ্যকর তদুপরি এমন লম্বা দিনে সুস্থ লোকেরাও রোজা রেখে অসুস্থ হয়ে কল্যাণ কামনায় বরং অকল্যাণ ডেকে আনে। রোজা অবস্থায় এ সময় অনেককে লজ্জা ভয়ে পালিয়ে পালিয়ে খেতেও দেখা যায়।

১০. এহেন অবস্থায় ছোয়াবের আশায় রোজা রেখে বরং সমূহ আপদ-বিপদ ডেকে আনে। এমন কষ্ট-ক্লেশের মধ্যে আল্লাহ কোন মতেই মানুষের কাছ থেকে রোজা চাহে না ; তা পরিস্কারভাবেই কোরানে ঘোষণা করেছে।

১১. উল্লিখিত প্রাকৃতিক বালা-মছিবত বা সমস্যাগুলির বাস্তব সত্যতা উপলব্দি করত সম্প্রতি ( ২০১০ ইং সন) মিশর বাধ্য হয়ে ঘড়ির কাটা আগ/পিছ করে ১ ঘণ্টা আগেই রোজা ভঙ্গের (ইফতার) সময় নির্ধারণ করে; একই কারণে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যহানি বা অসমর্থতা ও উৎপাদন ব্যহত হওয়ার কারণে আমিরাতের শ্রমিকদের রোজা রাখার কঠিন আদেশ রহিত করার ফতোয়া দেয়। (খবর: সিএনএন)

অদূর ভবিষ্যতে চাঁদ, সূর্য বা অন্য যে কোন গ্রহে মানুষ বসবাস করলেও এই একই নিয়মে তাদের যে কাল বা মাসটি তুলনায় কল্যাণকর পাবে ঠিক সেই মাসেই তারা রোজা রাখবে। আল্লাহর আইন সর্বত্র এবং সবার জন্য একরকম। এখানে কোন রকমের পক্ষপাতিত্ব বা প্রকৃতি বিরোধ নেই, নেই অসামাঞ্জস্যতা।

‘কোরান মনুষ্য জাতির জন্য’, একথা ওয়াজ-নছিহত ছাড়া বাস্তব প্রমাণ করার ক্ষমতা আমাদের নেই ; কারণ প্রচলিত রমজান অন্য গ্রহে তো দূরের কথা! পৃথিবীর উত্তর মেরু অঞ্চল, কানাডার নর্থওয়েস্ট টেরিটরি, নুনোভাট ও ইউকন টেরিটরি প্রভিন্সত্রয়; গ্রীনল্যান্ড, নরওয়ে, রাশিয়ার খানিক উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণ মেরুর এ্যান্টারটিকা প্রভৃতি এলাকায় ৬ মাস দিন ও ৬ মাস রাত্র; এমন দেশ আছে যেখানে ২০/২২ ঘণ্টা উত্তপ্ত দিন, ঐ সকল এলাকায় আদিকাল থেকেই প্রচলিত নামাজ, রোজা, শবে মেরাজ, শবেবরাত, শবেকদর প্রভৃতি অনুষ্ঠানাদি অচল হয়ে পড়ে আছে; অতএব তাদের নিজস্ব পবিবেশ, সময়-সুযোগ অনুযায়ী হিসাব নিকাশ করে তাদের অনুষ্ঠানাদির সময় সূচি নির্ধারণ করে নিতেই হয়।

একমাত্র আরব দেশকে অনুকরণ তথা চন্দ্র বর্ষের কারণে আজকের মুছলিম বিশ্বের রোজা, ঈদ, নবীর জন্মোৎসব, শ’বে-কদর, শ’বে বরাত, শ’বে-মেরাজ ইত্যাদি সকল ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি সময়ের হিসাবে চাঁদের ফাঁদে আবদ্ধ। অতএব, আরববাসী তথা মুছলিম বিশ্বের এক্ষণে উচিত:

ক. চন্দ্র বর্ষ ছেড়ে সৌর বর্ষ প্রবর্তন করা।

খ. ডাক্তার, বিজ্ঞানী, জ্যোতিষ বিজ্ঞানিদের সাহায্যে নবম মাস, ছোট্ট মাস রমজানকে এমনভাবে নির্ধারণ করা, যাতে সে-ই রাছুলের আমলের রমজানের সকল গুণাগুণ, বৈশিষ্ট্য তথা ফজিলত আজকের রমজানে স্থান পায়।

গ. বিশ্বকে ৪ভাগে বিভক্ত করে অথবা যে সমস্ত দেশের স্বতন্ত্র মাস আছে তারা স্বতন্ত্রভাবে তাদের মাসগুলির বিচার বিশ্লেষণ করে তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে কল্যাণের এবং ছোট মাসটি রোজার মাস হিসাবে সাব্যস্ত করা। ইহাই কোরানের নির্দেশ।

ফলে:

১. কোরানের সঠিক ব্যাখ্যা বলবৎ হবে।

২. মুছলিম বিশ্বের অথবা একই দেশে ধর্মানুষ্ঠানের দিন-তারিখ নিয়ে মতবিরোধ তথা অধর্ম বন্ধ হবে।

৩. রোজাদারীগণ রোজার প্রকৃত তাৎপর্য ও সমান ফলাফল উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে।

৪. শিশু ও বৃদ্ধগণ স্বতঃফূর্তভাবে রোজা পালনে আগ্রহী হবে।

৫. কথিত প্রগতিশীল ও অনাগ্রহশীলদের ধর্মের প্রতি আগ্রহ বাড়বে।

৬. শীত আর গ্রীষ্মকালের উপবাসের দৈহিক ও মানসিক কল্যাণের (ছোয়াব) ফলাফল যে এক হতে পারে না; বরং বিপরীত ও আকাশ-পাতাল পার্থক্য, তা প্রত্যেক রোজাদারীই বাস্তবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন।

৭. স্বজাতির মধ্যে একই ধর্মানুষ্ঠান নিয়ে লাঠালাঠি, খুনাখুনী বন্ধ হলে অন্য ধর্মাবলম্বীদের কোরানের প্রতি সন্দেহ অনেকটা দূর হবে।

৮. মুহম্মদের অনুসৃত সে-ই রমজান মাস আবার ফিরে পাবে।

৯. আল্লাহর কেতাবের ফয়সালার উপর রাজা-বাদশা বা চাঁদ দেখা কমিটির কুফুরি হস্তক্ষেপ বন্ধ হবে।

১০. ‘কোরান মনুষ্য জাতির জন্য’ দাবিটা শুধু শ্লোগান সর্বস্বই থাকবে না বরং বাস্তবেই তা প্রমাণিত হবে।

১১. প্রত্যেকটি এলাকা বা দেশ স্ব-স্ব সময় অনুযায়ী রোজা, ঈদ ও হজ্জ পালন করবে। এ হজ্জটি জাতীয় বা দেশীয় হজ্জ হিসাবে স্বীকৃত হবে; আজ যাকে ওমরা হজ্জ বলে।

১২. বছরে একটি আন্তর্জাতিক হজ্জ অবশ্যই থাকবে; তার দিন-তারিখ কোরানেই নির্দিষ্ট করা আছে। সময়ক্ষণ গ্রীনউইচ সময় অনুযায়ী ধার্য হবে। এ হজ্জে প্রত্যেকটি দেশের জ্ঞানী-গুনীগণই প্রতিনিধি হিসাবে যোগদান করবে। তার মূল ও প্রধান উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য থাকবে প্রত্যেকটি দেশের যাবতীয় সমস্যাদি তুলে ধরা এবং তার স্থায়ী এবং সুস্পষ্ট ও সুষম সমাধান করা।

প্রত্যেকটি বস্তু-অবস্তুর বদলা রয়েছে। তা হিসাব-নিকাশ, গবেষণা ও আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ফয়সালা করে নিতে হয়। যেমন: ডলারকে টাকা, রিয়ালকে মার্ক; বাংলাকে আরবি; আরবিকে হিন্দি; জানুয়ারিকে পৌষ; অতঃপর রমজানকে পৌষ, পৌষকে ফেব্র“য়ারি করা সম্ভব; শুধুমাত্র দরকার গবেষণা ও হিসাব নিকাশের। এ সম্বন্ধে সুন্দর একটি আয়াত অনুসরণীয়:

আশ্বাহরুল…ক্বিছাছ। (২:বাকারা-১৯৪) অর্থ: নিষিদ্ধ (পবিত্র) মাসের বদলে নিষিদ্ধ (পবিত্র) মাস। এবং সবকিছুরই বদলা রয়েছে।

এতে আরবগণ সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে:

কোরানের বিধান মতে জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে একক আল্লাহতে বিশ্বাসী ও সঙ্গতি যার আছে, তাকে অবশ্যই শপথ বা হজ্জ করতে হবে। (৩: এমরান- ৯৬, ৯৭)

ধর্ম গুরু ইব্রাহিম, আর তারই বংশধর ও অনুসারি সকল মানবজাতি; এমন কি সকল রাছুল-নবীগণও। তিনিই কাবা ঘরের সংস্কারক। অতএব একক আল্লাহতে বিশ্বাসী সকল মুছলিম অমুছলিমদের সমান অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে এই কাবা ঘরের প্রতি। যে কোন ব্যক্তির হজ্জের ইচ্ছা এবং সঙ্গতি থাকলে তাকে বাধা দেয়ার অধিকার কোন মানুষ বা সরকারের নেই; পক্ষান্তরে সৌদি রাজাগণ কোরান বিরুদ্ধ, বে-আইনী ফতোয়া দিয়ে একক আল্লাহতে বিশ্বাসী অমুছলিমদের হজ্জ গমণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। তাছাড়া সৌদি সরকারের স্থানের অপ্রতুলতা, অদূরদর্শিতা, প্রাকৃতিক সমস্যা ইত্যাদির কারণে প্রত্যেকটি দেশের গমনেচ্ছুদের সংখ্যা নির্ধারিত করে দেয়া হয় ; যা কোরানের আলোতে বৈধ নয়। ফলে কোটি কোটি মানুষের ইচ্ছা ও আর্থিক সঙ্গতি থাকতেও তারা হজ্জ করতে পারছে না। অতএব, আজ প্রত্যেকটি দেশ রোজা, হজ্জ স্বতন্ত্র সময় পালন করলে:

ক. আরব সরকারের হজ্জ গমনেচ্ছুদের সংখ্যা নির্র্দিষ্ট করার দরকার হবে না।

খ. আরব সরকারের কোরানের নির্দেশ অমান্য করে দোযোখী হওয়ার প্রয়োজন পড়বে না।

গ. স্বভাবতঃই হাজীদের সংখ্যা লক্ষকোটি গুণ বৃদ্ধি পাবে। ফলে সৌদি সরকারের বৈদেশিক আয় ততোধিক বৃদ্ধি পাবে এবং তা কালাকাল যাবৎ বলবৎ থাকবে।

আরবদের তেলের পরিমাণ দিন দিন কমে আসছে, একদিন শেষও হবে। এমতাবস্থায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে হঠাৎ যে কোন সময় তেল ফুরিয়েও যেতে পারে; ধ্বংসও হয়ে যেতে পারে। অতএব সৌদি সরকারের উচিত নিকট অথবা দুর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এই কোরানিক তথ্যের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা।

কোরানে বর্ণিত “চন্দ্র ও সূর্য হিসাবের জন্য” বটে! চন্দ্র প্রধানত পৃথিবী পৃষ্ঠের পানি এবং জীব দেহের রক্ত প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ বা হিসাব দেয়; পক্ষান্তরে সূর্য প্রধানত সময়-কাল ও আবহাওয়ার হিসাব দেয়।

আমার দেশ, আমার ভাষা, আমার মাটি, আমার প্রকৃতি-পরিবেশ, আমার বিশ্বাস, আমার ধর্ম রক্ষা পবিত্র এবং সর্বশ্রেষ্ঠ দায়িত্ব ও কর্তব্য হিসাবে যুগ যুগ ধরে বিবেচিত হয়ে আসছে; সুতরাং এবারের সংগ্রাম হোক আমার নিজস্ব এবং নির্দিষ্ট কল্যাণকর কালে উপবাসব্রত ধারণের।

Leave a comment